কলকাতা, 12 জুলাই : "রোদে রোদে পড়ে থাকল ছেলেটা । কোনও হাসপাতাল সাহায্য করল না । এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে চিকিৎসা না পেয়ে ছেলেটা আমার মারা গেল । আমি স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক, এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব; যাতে অন্য কোনও মা-বাবাকে নিঃসন্তান হতে না হয় ।" বলছেন মৃত এক কিশোরের বাবা । ইছাপুরের বাসিন্দা 18 বছরের এই যুবকের শুক্রবার রাতে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় । সে কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছিল ।
এ-বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ওই যুবক । তার বাবা বেসরকারি এক সংস্থায় কর্মরত । মা সংসারের কাজকর্ম করেন । কয়েকদিন আগেই ওই যুবকের ইউরিনে সমস্যা দেখা দেয় । স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খায় সে । এরপর বমি হতে থাকে । গত বৃহস্পতিবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেদিনের মতো সুস্থ হয়ে উঠলেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে ৷ কিন্তু অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার সকালে আবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাবার কথায়, "ওর জ্বর, সর্দি, কাশি কিছুই ছিল না । হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গেল । শুক্রবার কামারহাটির ESI হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আমার ছেলের হাই সুগার রয়েছে । কিন্তু, এই হাসপাতলে ওর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কারণ ওকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হবে । একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা । ওর যে সুগার রয়েছে, তা আমরা এই প্রথম জানলাম ।"
এরপর বেসরকারি ওই নার্সিংহোমে গিয়ে অন্য এক অভিজ্ঞতা হল তাঁদের । দীর্ঘ সময় চলছে অপেক্ষা, অথচ চিকিৎসা শুরু হচ্ছে না । যুবকের বাবা তখন জানান, বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানাবেন । স্থানীয় বেলঘড়িয়া থানায় যোগাযোগের জন্য তিনি চেষ্টাও করেন । থানার নম্বর জোগাড় করে ফোন করেন তিনি । তবে রিং হয়ে যেতে থাকে । এর পরে 100 নম্বরে ফোন করেন তিনি । কলকাতা পুলিশের এলাকার মধ্যে না হওয়ায়, এই কিশোরের বাবাকে DG কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর দেওয়া হয় । এই কন্ট্রোল রুম থেকে বেলঘড়িয়া থানার যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়, তা একই ফোন নম্বর, যে ফোন নম্বরে বারবার ফোন করেও তিনি কথা বলতে পারেননি শুধু রিং হয়ে গেছে ।
তবে আবারও ফোন করেন, আবারও রিং হয়ে যায় । তাঁর এই উদ্যোগ বুঝতে বেসরকারি নার্সিং হোমেও তৎপরতা দেখা যায় । তাঁর ছেলের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে বেসরকারি ওই নার্সিংহোম থেকে জানানো হয় এই যুবক COVID-19-এ আক্রান্ত হয়েছে । কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে । কারণ, তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এমন হতে পারে । ওই নার্সিংহোম থেকে আক্রান্তকে তখন কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কামারহাটির ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে থেকে কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয় । তবে কামারহাটির এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা মেলেনি যুবকের । তার বাবা জানিয়েছেন, "ওই মেডিকেল কলেজ থেকে বলা হয়, আমার ছেলের COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দপ্তরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে না ।"
এরপর তাঁরা কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসার সিদ্ধান্ত নেন । তবে কীভাবে আসবেন? কোনও গাড়ি ভাড়া করতে পারছিলেন না । কারণ তাঁর ছেলে COVID-19 পজ়িটিভ । অবশেষে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে একটি ক্লাবের অ্যাম্বুলেন্সে করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শুক্রবার দুপুর দু'টো নাগাদ এই আক্রান্তকে নিয়ে আসা হয় । অভিযোগ, এই হাসপাতালে আসার পরেও চিকিৎসা মিলছিল না । কিশোরের বাবা বলেন, "সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় সুস্থ ছিল আমার ছেলে । কিন্তু এর পরে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে । একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল । অ্যাম্বুলেন্সে দীর্ঘ সময় পড়ে রয়েছে, চিকিৎসা হচ্ছে না, ওর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছিল ।"
দ্রুত যাতে তার চিকিৎসা শুরু করা হয় সে-জন্য বার বার হাসপাতালে অনুরোধ করছিলেন তাঁর মা-বাবা । তাঁদের এম আর বাঙুর কিংবা বেলেঘাটার ID&BG হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কিশোরের বাবা বলেন, "আমরা কাকুতি-মিনতি করছিলাম অন্তত যেন প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয় । কিন্তু আমার ছেলের চিকিৎসার শুরু হচ্ছিল না । শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী হাসপাতালে বলে, আমাদের ছেলের চিকিৎসা শুরু করা না হলে ও আত্মহত্যা করবেন । এই কথার পরে আমার ছেলেকে ভরতি নেওয়া হয় ।"
শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই যুবককে ভরতি নেওয়া হয় । সেদিনই সন্ধ্যার পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় এই হাসপাতালে COVID-19 রোগীদের চিকিৎসার বিল্ডিংয়ে । তাঁদের ছেলেকে তাঁরা তখন আর দেখতে পারবেন না, এই জন্য এই মা-বাবা দুজনেই গতকাল শুক্রবার বাড়িতে ফিরে যান । এরপর গতকাল সকালে এই যুবকের বাবাকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে গতরাতে । কার্যত বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এই যুবকের মা-বাবা ৷ এমন তো হওয়ার ছিল না !