ETV Bharat / city

"কোনও হাসপাতাল সাহায্য করল না, ছেলেটা আমার মারা গেল"

author img

By

Published : Jul 12, 2020, 2:19 AM IST

এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল শুধু ঘুরে গেছেন ৷ কিন্তু কোথায় ঠিকঠাক পরিষেবা মেলেনি ৷ চিকিৎসার গাফিলতির কারণেই তাঁর ছেলে প্রাণ হারিয়েছে বলে অভিযোগ মৃতের বাবার ৷

Kolkata COVID 19 Update
ছবি

কলকাতা, 12 জুলাই : "রোদে রোদে পড়ে থাকল ছেলেটা । কোনও হাসপাতাল সাহায্য করল না । এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে চিকিৎসা না পেয়ে ছেলেটা আমার মারা গেল । আমি স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক, এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব; যাতে অন্য কোনও মা-বাবাকে নিঃসন্তান হতে না হয় ।" বলছেন মৃত এক কিশোরের বাবা । ইছাপুরের বাসিন্দা 18 বছরের এই যুবকের শুক্রবার রাতে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় । সে কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছিল ।

এ-বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ওই যুবক । তার বাবা বেসরকারি এক সংস্থায় কর্মরত । মা সংসারের কাজকর্ম করেন । কয়েকদিন আগেই ওই যুবকের ইউরিনে সমস্যা দেখা দেয় । স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খায় সে । এরপর বমি হতে থাকে । গত বৃহস্পতিবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেদিনের মতো সুস্থ হয়ে উঠলেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে ৷ কিন্তু অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার সকালে আবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাবার কথায়, "ওর জ্বর, সর্দি, কাশি কিছুই ছিল না । হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গেল । শুক্রবার কামারহাটির ESI হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আমার ছেলের হাই সুগার রয়েছে । কিন্তু, এই হাসপাতলে ওর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কারণ ওকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হবে । একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা । ওর যে সুগার রয়েছে, তা আমরা এই প্রথম জানলাম ।"

এরপর বেসরকারি ওই নার্সিংহোমে গিয়ে অন্য এক অভিজ্ঞতা হল তাঁদের । দীর্ঘ সময় চলছে অপেক্ষা, অথচ চিকিৎসা শুরু হচ্ছে না । যুবকের বাবা তখন জানান, বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানাবেন । স্থানীয় বেলঘড়িয়া থানায় যোগাযোগের জন্য তিনি চেষ্টাও করেন । থানার নম্বর জোগাড় করে ফোন করেন তিনি । তবে রিং হয়ে যেতে থাকে । এর পরে 100 নম্বরে ফোন করেন তিনি । কলকাতা পুলিশের এলাকার মধ্যে না হওয়ায়, এই কিশোরের বাবাকে DG কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর দেওয়া হয় । এই কন্ট্রোল রুম থেকে বেলঘড়িয়া থানার যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়, তা একই ফোন নম্বর, যে ফোন নম্বরে বারবার ফোন করেও তিনি কথা বলতে পারেননি শুধু রিং হয়ে গেছে ।

তবে আবারও ফোন করেন, আবারও রিং হয়ে যায় । তাঁর এই উদ্যোগ বুঝতে বেসরকারি নার্সিং হোমেও তৎপরতা দেখা যায় । তাঁর ছেলের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে বেসরকারি ওই নার্সিংহোম থেকে জানানো হয় এই যুবক COVID-19-এ আক্রান্ত হয়েছে । কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে । কারণ, তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এমন হতে পারে । ওই নার্সিংহোম থেকে আক্রান্তকে তখন কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কামারহাটির ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে থেকে কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয় । তবে কামারহাটির এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা মেলেনি যুবকের । তার বাবা জানিয়েছেন, "ওই মেডিকেল কলেজ থেকে বলা হয়, আমার ছেলের COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দপ্তরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে না ।"

এরপর তাঁরা কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসার সিদ্ধান্ত নেন । তবে কীভাবে আসবেন? কোনও গাড়ি ভাড়া করতে পারছিলেন না । কারণ তাঁর ছেলে COVID-19 পজ়িটিভ । অবশেষে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে একটি ক্লাবের অ্যাম্বুলেন্সে করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শুক্রবার দুপুর দু'টো নাগাদ এই আক্রান্তকে নিয়ে আসা হয় । অভিযোগ, এই হাসপাতালে আসার পরেও চিকিৎসা মিলছিল না । কিশোরের বাবা বলেন, "সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় সুস্থ ছিল আমার ছেলে । কিন্তু এর পরে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে । একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল । অ্যাম্বুলেন্সে দীর্ঘ সময় পড়ে রয়েছে, চিকিৎসা হচ্ছে না, ওর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছিল ।"

দ্রুত যাতে তার চিকিৎসা শুরু করা হয় সে-জন্য বার বার হাসপাতালে অনুরোধ করছিলেন তাঁর মা-বাবা । তাঁদের এম আর বাঙুর কিংবা বেলেঘাটার ID&BG হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কিশোরের বাবা বলেন, "আমরা কাকুতি-মিনতি করছিলাম অন্তত যেন প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয় । কিন্তু আমার ছেলের চিকিৎসার শুরু হচ্ছিল না । শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী হাসপাতালে বলে, আমাদের ছেলের চিকিৎসা শুরু করা না হলে ও আত্মহত্যা করবেন । এই কথার পরে আমার ছেলেকে ভরতি নেওয়া হয় ।"

শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই যুবককে ভরতি নেওয়া হয় । সেদিনই সন্ধ্যার পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় এই হাসপাতালে COVID-19 রোগীদের চিকিৎসার বিল্ডিংয়ে । তাঁদের ছেলেকে তাঁরা তখন আর দেখতে পারবেন না, এই জন্য এই মা-বাবা দুজনেই গতকাল শুক্রবার বাড়িতে ফিরে যান । এরপর গতকাল সকালে এই যুবকের বাবাকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে গতরাতে । কার্যত বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এই যুবকের মা-বাবা ৷ এমন তো হওয়ার ছিল না !

গতকাল সকাল 10 টা নাগাদ তাঁরা কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছান । মৃতের বাবার কথায়, "আমাদের ছেলের COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছে, তাই ওর দেহ আমাদের দেওয়া হবে না । আমাকে ডিক্লেয়ারেশন দেওয়ার কথা বলা হয় । আমি জানতে চাই, আমার ছেলেকে কীভাবে বলা হচ্ছে যে ও COVID-19 পজ়িটিভ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কি পরীক্ষা হয়েছে? বেসরকারি একটি নার্সিংহোম থেকে একটা চিরকুটে লিখে দেওয়া হল COVID-19 পজ়িটিভ আর এই হাসপাতাল থেকেও বলা হবে আমার ছেলে COVID-19 পজ়িটিভ?" মানতে পারছিলেন না তাঁরা । তবুও শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলেন । যুবকের বাবাকে ডিক্লেয়ারেশন দিতে হল ।

আজ তাঁরা আবার যাবেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । তাঁদের ছেলের দেহ আজ সৎকারের জন্য নিয়ে যাবে প্রশাসন । ছেলেকে শেষবারের মতো একবার দেখতে তাঁরা যাবেন । মৃত যুবকের বাবার কথায়, "চিকিৎসা না হওয়ার ফলে ছেলে পুরো ঝিমিয়ে পড়ল । শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ৷ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল । রোদে রোদে পড়ে থাকল কোন হাসপাতাল সাহায্য করল না । এই হাসপাতাল ওই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে আমার ছেলেটা মরেই গেল ।"

এই ঘটনায় কোনও অভিযোগ জানাবেন কোথাও? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "অবশ্যই অভিযোগ জানাব । আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব । আমার ছেলের সঙ্গে এমন হল, আমার একটি মাত্র সন্তান, আমি নিঃসন্তান হয়ে গেলাম । যাতে আর কোনও মা-বাবার সন্তানের সঙ্গে এমন না হয়, তাঁর জন্য আমাকে এই লড়াইটা লড়তে হবে । সরকার যাতে ব্যবস্থা নেয়, তার জন্য যত দূর যেতে হয়, যাব ।"

এই ঘটনায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এই যুবক COVID-19 পজ়িটিভ ছিল । যখন যুবককে শুক্রবার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন বেড ফাঁকা ছিল না । শারীরিক অবস্থাও ভালো ছিল না । ব্লাড সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল । এই অবস্থায় প্রথমে ইমারজেন্সিতে চিকিৎসা শুরু করা হয় । পরে বেড ফাঁকা হলে ভরতি নেওয়া হয় ।"

এদিকে শুধুমাত্র এমন ঘটনা নয় । শনিবার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত এক COVID-19 রোগীর মৃত্যুর পরে দেহ না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন পরিজনরা । যদিও, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই দুই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এ দিন লিখিত কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি ।

গত 30 মে থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভরতি ছিলেন এক COVID-19 রোগী । এই রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন । কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে গত 29 মে এই রোগীর COVID-19 পজ়িটিভ ধরা পড়ায় সেখানে আর ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়নি । এই রোগীর পরিজনদের তরফে জানানো হয়েছে, "মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভরতি করানোর পরে এই রোগীর দুই বার COVID-19 টেস্টের রিপোর্টে পজ়িটিভ পাওয়া যায় । এরপর 6 জুলাই ফের এই রোগীর COVID-19 টেস্ট করে জানা যায় তাঁর COVID-19 নেগেটিভ হয়েছে । গতকাল এই রোগীর মৃত্যু হয় । পরিজনদের তরফে অভিযোগ, এই রোগীকে তাঁরা এই হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে নিয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করানোর কথা বলেছিলেন । কিন্তু, এই হাসপাতাল থেকে রোগীকে ছুটি দেওয়া হয়নি । রোগীর চিকিৎসার জন্য শেষ সুযোগ তাঁরা পেলেন না । এদিকে, শনিবার হাসপাতাল থেকে পরিজনদের জানানো হয়, মৃতদেহ পরিজনদের দেওয়া হবে না । মৃতদেহের সৎকার করবে প্রশাসন‌ । টেস্টের রিপোর্টে নেগেটিভ হওয়া সত্বেও দেহ কেন পরিজনদের দেওয়া হবে না, তা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন রোগীর পরিজনরা ।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, প্রোটোকল অনুযায়ী ক্যান্সারের কোনও রোগীর COVID-19 পজ়িটিভ হলে যতক্ষণ না তাঁর COVID-19 নেগেটিভ হচ্ছে, ততক্ষণ ক্যান্সারের কোনও চিকিৎসা করা হয় না । কারণ এর ফলে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে । এই রোগীর COVID-19 টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও এই পরীক্ষার জন্য তাঁর সোয়াবের নমুনা সংগ্রহের সময় থেকে রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত এই রোগী অন্য COVID-19 রোগীদের সঙ্গে একই ওয়ার্ডে ছিলেন । নমুনা সংগ্রহের পরেও এই রোগী ছিলেন অন‍্য COVID-19 রোগীদের সঙ্গে । এর মধ্যে এই রোগীর আবার সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে । এই কারণে মৃতদেহ পরিজনদের হাতে তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।

কলকাতা, 12 জুলাই : "রোদে রোদে পড়ে থাকল ছেলেটা । কোনও হাসপাতাল সাহায্য করল না । এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে চিকিৎসা না পেয়ে ছেলেটা আমার মারা গেল । আমি স্বাধীন দেশের একজন নাগরিক, এর শেষ আমি দেখে ছাড়ব; যাতে অন্য কোনও মা-বাবাকে নিঃসন্তান হতে না হয় ।" বলছেন মৃত এক কিশোরের বাবা । ইছাপুরের বাসিন্দা 18 বছরের এই যুবকের শুক্রবার রাতে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত্যু হয় । সে কোরোনায় আক্রান্ত হয়েছিল ।

এ-বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ওই যুবক । তার বাবা বেসরকারি এক সংস্থায় কর্মরত । মা সংসারের কাজকর্ম করেন । কয়েকদিন আগেই ওই যুবকের ইউরিনে সমস্যা দেখা দেয় । স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খায় সে । এরপর বমি হতে থাকে । গত বৃহস্পতিবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় । সেদিনের মতো সুস্থ হয়ে উঠলেও হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে ৷ কিন্তু অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় শুক্রবার সকালে আবার কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বাবার কথায়, "ওর জ্বর, সর্দি, কাশি কিছুই ছিল না । হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গেল । শুক্রবার কামারহাটির ESI হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আমার ছেলের হাই সুগার রয়েছে । কিন্তু, এই হাসপাতলে ওর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কারণ ওকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হবে । একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা । ওর যে সুগার রয়েছে, তা আমরা এই প্রথম জানলাম ।"

এরপর বেসরকারি ওই নার্সিংহোমে গিয়ে অন্য এক অভিজ্ঞতা হল তাঁদের । দীর্ঘ সময় চলছে অপেক্ষা, অথচ চিকিৎসা শুরু হচ্ছে না । যুবকের বাবা তখন জানান, বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানাবেন । স্থানীয় বেলঘড়িয়া থানায় যোগাযোগের জন্য তিনি চেষ্টাও করেন । থানার নম্বর জোগাড় করে ফোন করেন তিনি । তবে রিং হয়ে যেতে থাকে । এর পরে 100 নম্বরে ফোন করেন তিনি । কলকাতা পুলিশের এলাকার মধ্যে না হওয়ায়, এই কিশোরের বাবাকে DG কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর দেওয়া হয় । এই কন্ট্রোল রুম থেকে বেলঘড়িয়া থানার যে ফোন নম্বর দেওয়া হয়, তা একই ফোন নম্বর, যে ফোন নম্বরে বারবার ফোন করেও তিনি কথা বলতে পারেননি শুধু রিং হয়ে গেছে ।

তবে আবারও ফোন করেন, আবারও রিং হয়ে যায় । তাঁর এই উদ্যোগ বুঝতে বেসরকারি নার্সিং হোমেও তৎপরতা দেখা যায় । তাঁর ছেলের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে বেসরকারি ওই নার্সিংহোম থেকে জানানো হয় এই যুবক COVID-19-এ আক্রান্ত হয়েছে । কার্যত মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে । কারণ, তাঁরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এমন হতে পারে । ওই নার্সিংহোম থেকে আক্রান্তকে তখন কামারহাটির ESI হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কামারহাটির ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে থেকে কলেজ অফ মেডিসিন অ্যান্ড সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলা হয় । তবে কামারহাটির এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা মেলেনি যুবকের । তার বাবা জানিয়েছেন, "ওই মেডিকেল কলেজ থেকে বলা হয়, আমার ছেলের COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দপ্তরের তালিকায় দেখা যাচ্ছে না ।"

এরপর তাঁরা কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আসার সিদ্ধান্ত নেন । তবে কীভাবে আসবেন? কোনও গাড়ি ভাড়া করতে পারছিলেন না । কারণ তাঁর ছেলে COVID-19 পজ়িটিভ । অবশেষে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে একটি ক্লাবের অ্যাম্বুলেন্সে করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শুক্রবার দুপুর দু'টো নাগাদ এই আক্রান্তকে নিয়ে আসা হয় । অভিযোগ, এই হাসপাতালে আসার পরেও চিকিৎসা মিলছিল না । কিশোরের বাবা বলেন, "সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় সুস্থ ছিল আমার ছেলে । কিন্তু এর পরে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে । একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল । অ্যাম্বুলেন্সে দীর্ঘ সময় পড়ে রয়েছে, চিকিৎসা হচ্ছে না, ওর শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেছিল ।"

দ্রুত যাতে তার চিকিৎসা শুরু করা হয় সে-জন্য বার বার হাসপাতালে অনুরোধ করছিলেন তাঁর মা-বাবা । তাঁদের এম আর বাঙুর কিংবা বেলেঘাটার ID&BG হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয় । কিশোরের বাবা বলেন, "আমরা কাকুতি-মিনতি করছিলাম অন্তত যেন প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয় । কিন্তু আমার ছেলের চিকিৎসার শুরু হচ্ছিল না । শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী হাসপাতালে বলে, আমাদের ছেলের চিকিৎসা শুরু করা না হলে ও আত্মহত্যা করবেন । এই কথার পরে আমার ছেলেকে ভরতি নেওয়া হয় ।"

শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই যুবককে ভরতি নেওয়া হয় । সেদিনই সন্ধ্যার পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় এই হাসপাতালে COVID-19 রোগীদের চিকিৎসার বিল্ডিংয়ে । তাঁদের ছেলেকে তাঁরা তখন আর দেখতে পারবেন না, এই জন্য এই মা-বাবা দুজনেই গতকাল শুক্রবার বাড়িতে ফিরে যান । এরপর গতকাল সকালে এই যুবকের বাবাকে হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, তাঁর ছেলের মৃত্যু হয়েছে গতরাতে । কার্যত বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন এই যুবকের মা-বাবা ৷ এমন তো হওয়ার ছিল না !

গতকাল সকাল 10 টা নাগাদ তাঁরা কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছান । মৃতের বাবার কথায়, "আমাদের ছেলের COVID-19 পজ়িটিভ হয়েছে, তাই ওর দেহ আমাদের দেওয়া হবে না । আমাকে ডিক্লেয়ারেশন দেওয়ার কথা বলা হয় । আমি জানতে চাই, আমার ছেলেকে কীভাবে বলা হচ্ছে যে ও COVID-19 পজ়িটিভ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কি পরীক্ষা হয়েছে? বেসরকারি একটি নার্সিংহোম থেকে একটা চিরকুটে লিখে দেওয়া হল COVID-19 পজ়িটিভ আর এই হাসপাতাল থেকেও বলা হবে আমার ছেলে COVID-19 পজ়িটিভ?" মানতে পারছিলেন না তাঁরা । তবুও শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হলেন । যুবকের বাবাকে ডিক্লেয়ারেশন দিতে হল ।

আজ তাঁরা আবার যাবেন কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । তাঁদের ছেলের দেহ আজ সৎকারের জন্য নিয়ে যাবে প্রশাসন । ছেলেকে শেষবারের মতো একবার দেখতে তাঁরা যাবেন । মৃত যুবকের বাবার কথায়, "চিকিৎসা না হওয়ার ফলে ছেলে পুরো ঝিমিয়ে পড়ল । শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ৷ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল । রোদে রোদে পড়ে থাকল কোন হাসপাতাল সাহায্য করল না । এই হাসপাতাল ওই হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে আমার ছেলেটা মরেই গেল ।"

এই ঘটনায় কোনও অভিযোগ জানাবেন কোথাও? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "অবশ্যই অভিযোগ জানাব । আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব । আমার ছেলের সঙ্গে এমন হল, আমার একটি মাত্র সন্তান, আমি নিঃসন্তান হয়ে গেলাম । যাতে আর কোনও মা-বাবার সন্তানের সঙ্গে এমন না হয়, তাঁর জন্য আমাকে এই লড়াইটা লড়তে হবে । সরকার যাতে ব্যবস্থা নেয়, তার জন্য যত দূর যেতে হয়, যাব ।"

এই ঘটনায় কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এই যুবক COVID-19 পজ়িটিভ ছিল । যখন যুবককে শুক্রবার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন বেড ফাঁকা ছিল না । শারীরিক অবস্থাও ভালো ছিল না । ব্লাড সুগারের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল । এই অবস্থায় প্রথমে ইমারজেন্সিতে চিকিৎসা শুরু করা হয় । পরে বেড ফাঁকা হলে ভরতি নেওয়া হয় ।"

এদিকে শুধুমাত্র এমন ঘটনা নয় । শনিবার কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ক্যান্সারে আক্রান্ত এক COVID-19 রোগীর মৃত্যুর পরে দেহ না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন পরিজনরা । যদিও, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই দুই ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এ দিন লিখিত কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি ।

গত 30 মে থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভরতি ছিলেন এক COVID-19 রোগী । এই রোগী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন । কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে গত 29 মে এই রোগীর COVID-19 পজ়িটিভ ধরা পড়ায় সেখানে আর ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়নি । এই রোগীর পরিজনদের তরফে জানানো হয়েছে, "মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভরতি করানোর পরে এই রোগীর দুই বার COVID-19 টেস্টের রিপোর্টে পজ়িটিভ পাওয়া যায় । এরপর 6 জুলাই ফের এই রোগীর COVID-19 টেস্ট করে জানা যায় তাঁর COVID-19 নেগেটিভ হয়েছে । গতকাল এই রোগীর মৃত্যু হয় । পরিজনদের তরফে অভিযোগ, এই রোগীকে তাঁরা এই হাসপাতাল থেকে ছুটি করিয়ে নিয়ে অন্যত্র চিকিৎসা করানোর কথা বলেছিলেন । কিন্তু, এই হাসপাতাল থেকে রোগীকে ছুটি দেওয়া হয়নি । রোগীর চিকিৎসার জন্য শেষ সুযোগ তাঁরা পেলেন না । এদিকে, শনিবার হাসপাতাল থেকে পরিজনদের জানানো হয়, মৃতদেহ পরিজনদের দেওয়া হবে না । মৃতদেহের সৎকার করবে প্রশাসন‌ । টেস্টের রিপোর্টে নেগেটিভ হওয়া সত্বেও দেহ কেন পরিজনদের দেওয়া হবে না, তা নিয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলেন রোগীর পরিজনরা ।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে অবশ্য জানানো হয়েছে, প্রোটোকল অনুযায়ী ক্যান্সারের কোনও রোগীর COVID-19 পজ়িটিভ হলে যতক্ষণ না তাঁর COVID-19 নেগেটিভ হচ্ছে, ততক্ষণ ক্যান্সারের কোনও চিকিৎসা করা হয় না । কারণ এর ফলে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে পারে । এই রোগীর COVID-19 টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও এই পরীক্ষার জন্য তাঁর সোয়াবের নমুনা সংগ্রহের সময় থেকে রিপোর্ট পাওয়া পর্যন্ত এই রোগী অন্য COVID-19 রোগীদের সঙ্গে একই ওয়ার্ডে ছিলেন । নমুনা সংগ্রহের পরেও এই রোগী ছিলেন অন‍্য COVID-19 রোগীদের সঙ্গে । এর মধ্যে এই রোগীর আবার সংক্রমণ ঘটে যেতে পারে । এই কারণে মৃতদেহ পরিজনদের হাতে তুলে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.