কলকাতা, 29 নভেম্বর : আজ সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হল 200 বছর পুরানো একটি সিন্দুক। যেখান থেকে পাওয়া গেছে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নথিপত্র । 1830 সাল থেকে 1956 সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সম্পত্তির নথি, 1919 সালের মেডেলের মতো ঐতিহাসিক জিনিস মিলেছে সিন্দুক ভেঙে । বিধবা ভাতার নথি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারের মতো দুষ্প্রাপ্য নথিও মিলেছে প্রাচীন ওই সিন্দুক থেকে । সব মিলিয়ে আজ এখানে একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় শুরু হল বলে মনে করছেন সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় ।
পুজোর পরেই উপাচার্য হয়ে সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এসেছেন সোমা বন্দোপাধ্যায় । তাঁর নজরে আসে গুদামঘরে পড়ে থাকা এই ব্রিটিশ আমলের সিন্দুকটি । উপাচার্য সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আমার ইতিহাসও একটা বিষয় ছিল । আমি নিজে ভাষা সাহিত্যের একজন অধ্যাপিকা । রাজ্য সরকার যখন সংস্কৃত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার পদক্ষেপ নিল তখন একটি এক সদস্যের কমিটি তৈরি করা হয়েছিল । সেই কমিটি রিপোর্ট দেয় । যেখানে বলা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী পালনের জন্য একটা আর্কাইভ করার কথা । আমি দেখলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কিছু ব্যবহৃত নথিপত্র আছে, আবার কিছু এমন নথিপত্র আছে যেগুলো সংরক্ষিত হচ্ছে না । আমার তখনই মাথায় এল একটা আর্কাইভ করার একদম ঠিক সময় । আমি তখন খুঁজতে শুরু করলাম। তখন জানতে পারলাম একটা ওয়াল সেফ আছে । সেই সেফটা কিছুকাল আগেও হয়ত ব্যবহার করা হত । সেই সেফ থেকে আমরা 85টি এনডাওমেন্ট ফান্ডের নথি পেলাম । তারপরে আমি খুঁজতে শুরু করলাম এখানে আর কী কী আছে । তখন দেখলাম একটা গুদামঘরে পড়ে রয়েছে এই সিন্দুকটা । তারপরেই এটা খোলার ব্যবস্থা করলাম । আমার মনে হল ওটার ভিতরে এমন কিছু নথি থাকতে পারে যেটা গবেষণার ক্ষেত্রে একটা অধ্যায় সৃষ্টি করবে । আমার সেই ধারণা সত্যি হল ।"
আজ এই সিন্দুকটি খুলতে অনেক সময় লেগেছে । সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, আজ প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছে এই সিন্দুকটি খুলতে। সিন্দুকটির জন্য কোনও চাবি খুঁজেও পাওয়া যায়নি । চাবি খেলানোর জন্য যিনি এসেছিলেন তিনি চাবি বানানোর চেষ্টা করেও সফল হননি । আর সিন্দুকটিরও ঐতিহাসিক মূল্য থাকায় সেটিকে ভাঙতে চায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ । অবশেষে কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সিন্দুকটির দরজা খুলতে পারলেও সিন্দুকের ভিতরে থাকা সেফ খুলতে সমস্যা দেখা দেয় । তারপরে ছেনি দিয়ে খোলা হয় সেফটি । সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "পাঁচ ঘণ্টা সময় লেগেছে সিন্দুকটা খুলতে। আমরা সেফটা ভাঙতে চাইছিলাম না । ওটাকেও তো ঐতিহাসিক দ্রব্য হিসেবে রাখা হবে । যে সিন্দুকটা পাওয়া গেছে সেটা বহু পুরানো । লন্ডনের CHUBB কম্পানির তৈরি করা এটা । ব্রিটিশ আমলের সিন্দুক।"
সিন্দুকটি খুলতেই দেখতে পাওয়া যায় বেশ কয়েকটি খাম, মেডেল ও নথিপত্র । কী কী ছিল সেখানে?
সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি পাওয়া গেছে। যেমন, বিভিন্ন ডিক্লারেশন অফ অ্যাসেটস । কেউ হয়ত কোনও সম্পত্তি দান করেছেন বা অর্জিত সম্পত্তি আছে, অনেক সূত্রেই পাওয়া সম্পত্তির হিসেব পাচ্ছি 1830 থেকে 1956 সাল পর্যন্ত । একটা মেডেল পাওয়া গেছে 100 বছর পুরানো । সংস্কৃত কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে যৌথভাবে যে সংস্কৃতে প্রথম হত তাঁকে এই মেডেল দেওয়া হত । 1919 সালের সেই মেডেলটা 100 বছর পর আমরা পেলাম ওই সিন্দুকটা খুলে । মহামহোপাধ্যায় উপাধি দেওয়া হত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও সেই উপাধি দেওয়া হয়েছিল । তাঁর স্বাক্ষর করা একটি রেজিস্টার পাওয়া গেছে । শুধু তিনি নন । অন্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্বাক্ষরও রয়েছে সেই রেজিস্টারে ।"
পাওয়া গেছে বিধবা ভাতা দেওয়ার নথি সহ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংক্রান্ত কিছু ঐতিহাসিক নথি । সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আরেকটা জিনিস পেয়েছি যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে একজন মহিলা হিসাবে সেটা হল বিধবা ভাতা দেওয়া হত 2 টাকা করে । তার মানে এটা যে শুধু এডুকেশনাল রিফর্মস হত এখান থেকে তা নয়, সামাজিক রিফর্মসও হত । একটা শিক্ষা সংস্থা থেকে এই বিধবা ভাতা দেওয়া, এটা একটা বিরাট বড় দৃষ্টান্ত । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাদের জন্য অনেক রকম কাজ করেছিলেন । ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে উনি অনেক বিধবাকে সাহায্য করেছিলেন । আমি যে কাগজটা পেয়েছি তাতে আটজন নিতেন । তাঁদের মধ্যে ছয়জন লিখতে জানতেন না । তাঁরা টিপসই দিয়ে নিতেন । বাকি দুজন লিখেছেন 'আমরা এই টাকা পাইলাম' । আর একটা অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার পেয়েছি । যেখানে 1829 সাল থেকে 1832 সাল পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের । তিনি সেই সময় ছাত্র ছিলেন ।" 1956 পর্যন্ত বিভিন্ন স্কলারশিপ, ব্যাঙ্কে নথি পাওয়া গেছে সিন্দুকে ।
সিন্দুক থেকে পাওয়া এই সমস্ত নথি ও জিনিস দিয়ে একটি আর্কাইভ করার হবে বলে জানাচ্ছেন সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "গবেষণার দিক থেকে, ঐতিহাসিক দিক থেকে ও সামাজিক দিক থেকে এইসব নথির বিশাল গুরুত্ব আছে । এর বিশাল আর্কাইভ্যাল ভ্যালু । আমরা একটা আর্কাইভ করার পরিকল্পনা করছি যেখানে এই সমস্ত জিনিসগুলো প্রদর্শনী করা হবে। কারণ, গবেষণার জন্য এগুলো দরকার । তাঁর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ এটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বি-শতবর্ষ । তাই আমার মনে হয় এটা যদি করা যায় তাহলে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হবে। আজ বিরাট একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী রইলাম আমরা । ইতিহাসের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হল । কারণ, এগুলো সংরক্ষণ করা না হলে নষ্ট হয়ে যাবে ।"