কলকাতা, 5 মে : 1932 সালের 23 সেপ্টেম্বর । রাত 10টা 45 মিনিট নাগাদ এক পঞ্জাবি ব্যক্তির সঙ্গে লুঙ্গি ও শার্ট পরিহিত একটি দল চট্টগ্রামের পাহাড়তালি ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে জড়ো হলেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় । ক্লাবে ছিল বেশ কয়েকজন পুলিশ । তারা পালটা গুলি চালায় । গুরুতর জখম হন পঞ্জাবি ব্যক্তি । পুলিশের হাতে ধরার পড়ার আগে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেন । কিন্তু, কে তিনি ? উত্তরটা পেতে আজ থেকে পিছিয়ে যেতে হবে ঠিক 108 বছর ।
1911 সালের 5 মে । চট্টগ্রাম পৌরসভার করণিক জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার (দাশগুপ্ত) ও প্রতিভাময়ী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে । নাম রাখা হল প্রীতিলতা । ডাকনাম রানি । ডাক্তার খাস্তাগির গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে ভরতি হন প্রীতিলতা । ছোটো থেকেই প্রখর বুদ্ধিমতী, কল্পনাবিলাসী ছিলেন । ভালোবাসতেন সাহিত্য । ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা বোর্ড থেকে প্রথম হন । তারপর কলকাতার বেথুন কলেজে। ডিসটিংশন সমেত দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক হন । কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর শংসাপত্র আটকে দেয় । তারপর চট্টগ্রামে ফিরে আসেন । নন্দনকানন অপর্ণাচরণ নামে স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন । কিছুদিন পর প্রধান শিক্ষিকা হন । আরও পাঁচজনের মতো জীবনযাপন করলেও স্বাধীনতা আন্দোলনে বরাবর অনুপ্রাণিত ছিলেন প্রীতিলতা । তাঁর প্রমাণও মেলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অন্যতম নায়িকা কল্পনা দত্তর জীবনীতে । যিনি প্রীতিলতার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়তেন । কল্পনা লেখেন, "স্কুলে পড়ার সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের কোনও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না । তারপর ঝাঁসির রানির আমাদের চিন্তাকে বাড়ায় । মাঝেমধ্যে আমরা নিজেদের ভয়ডরহীন ভাবতাম । " তখন থেকেই হয়ত প্রীতিলতার মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার বাসনা আরও তীব্র হতে থাকে ।
1930-র দশকে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রীতিলতা । তখন চট্টগ্রামে বিপ্লবী হিসেবে আদর্শ হয়ে উঠেছেন সূর্য সেন । ধলঘাটের ক্যাম্পে মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করেন প্রীতিলতা । সঙ্গে ছিলেন অপর এক বিপ্লবী নির্মল সেন । সূর্য সেন চাইতেন, প্রীতিলতা তাঁদের দলে যোগ দেন । কিন্তু, বিরোধিতা করেন বিনোদবিহারী চৌধুরি । তিনি যুক্তি দেন, তাঁদের সশস্ত্র সংগ্রামী দলে মহিলারা যোগদান করেন না । যদিও পরে নিজের অবস্থান পালটান তিনি । দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রীতিলতার দৃঢ় মনোভাব ও দেশের প্রতি ভালোবাসা আকর্ষণ করে মাস্টারদাকে । প্রীতিলতাকে নিজের দলের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন । তাঁর যোগদানের স্বপক্ষে যুক্তি ছিল, মেয়েরা অস্ত্র পাচার করলে তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হবে না ।
ব্রিটিশদের ধাক্কা দিতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করেন মাস্টারদা । 1930 সালের 18 এপ্রিল মাস্টারদা, প্রীতিলতা ও 60-র অধিক বিপ্লবীর সঙ্গে চট্টগ্রামের দুটি প্রধান অস্ত্রাগার লুট করে । কলকাতার সঙ্গে টেলিগ্রাম, টেলিফোন ও রেল ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় । রিজ়ার্ভ পুলিশ লাইনও দখল করে নেয় বিপ্লবীরা । পরবর্তী দু'বছরে বিস্ফোরক সরবরাহ করতে থাকেন প্রীতিলতা । জাতীয়তাবাদী পুস্তিকা লিখতে থাকেন । তখন মাস্টারদার অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস জেলে ছিলেন । প্রীতিলতার মাধ্যমে রামকৃষ্ণর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন মাস্টারদা ।
তারপর আসে 1932 সালের সেপ্টেম্বর মাস । চট্টগ্রামের পাহাড়তালি ইউরোপিয়ান ক্লাবের দরজায় টাঙানো বোর্ডে লেখা ছিল, "কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশের অনুমতি নেই (Dogs and Indians are not allowed )" । সেখানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন মাস্টারদা । সেই দলের দায়িত্ব পান প্রীতিলতা । সেই মতো পঞ্জাবি ছদ্মবেশে যান । পুলিশের সঙ্গে গুলির লড়াই শুরু হয় । কিন্তু, আত্মসমর্পণ করেননি প্রীতিলতা । নিজেকে অত্যাচারিত হতে দেননি ইংরেজদের হাতে । মাত্র 21 বছর বয়সে দেশের স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন । মৃত্যুর আগে প্রীতিলতা বলেছিলেন, "আমার আশা, আমার বোনেরা আর নিজেদের দুর্বল ভাববে না । তারা হাজারে হাজারে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবে । যে কোনও বিপদের সম্মুখীন হতে নিজেদের তৈরি করবে । " প্রীতিলতার ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন আরও প্রীতিলতারা । তাঁর জীবনকে বৃথা যেতে দেননি । প্রীতিলতার মৃত্যুর 15 বছর পর ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয় ভারত । কিন্তু,
প্রীতিলতার সংগ্রাম বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে । আজ তাঁর 108 তম জন্মদিনেও কোথাও যেন চাপা পড়ে গেছে তাঁর স্মৃতিকথা । তাতে কী ? যে প্রীতিলতা নিজের পরোয়া না করে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন, দেশের মানুষ তাঁকে কী সম্মান দিলেন বা নাই দিলেন তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না । কারণ তিনি দেশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে বিপ্লবের যে বীজ রোপণ করছিলেন , তা অচিরেই দেশকে স্বাধীনতার পথে দিশা দেখিয়েছিল ।