প্রশ্ন: আপনি বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন । সকালের খাবারের প্রকল্প হোক বা গৃহকর্ত্রীদের জন্য সাম্মানিক, যার মধ্যে একটি বিশাল আর্থিক বোঝা জড়িত ৷ সেগুলি পালন করার ক্ষেত্রে আপনি কোন চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হচ্ছেন ?
স্ট্যালিন: দ্রাবিড় মডেলের এই সরকারের কল্যাণমূলক কর্মসূচির মধ্যে মহিলাদের সাম্মানিক ভাতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । এই সমস্ত প্রকল্পগুলি শুধুমাত্র প্রতিদিনের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যেই নয়, ভবিষ্যতের উন্নয়নের ভিত্তি হিসাবে রয়েছে । তাই দ্রাবিড় মডেলের এই সরকার যে চ্যালেঞ্জই হোক না কেন, তা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।
গত কয়েক বছরে আমরা ঋণের বোঝা, আর্থিক ঘাটতি এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে উঠেছি । যদিও আমরা এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আর্থিক বরাদ্দ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারিনি ৷ তবুও আমরা রাজ্যকে উন্নয়নের পথে নিয়ে গিয়েছি । এখন পুরো দেশ তামিলনাড়ুর দিকে তাকিয়ে আছে অগ্রণী পরিকল্পনা ও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কারণে ।
প্রশ্ন: উত্তর ভারতে অত্যন্ত শক্তিশালী হিন্দুত্ববাদী সংহতি ভাঙতে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের কৌশল কী ?
স্ট্যালিন: সাম্প্রদায়িকতা ছাড়া বিজেপির আর কোনও আদর্শ নেই । তারা পারফরম্যান্সের উপর ভোট চাইতে অক্ষম ৷ তাই বিদ্বেষের রাজনীতির উপর ভিত্তি করে থাকে । কিন্তু ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের শক্তি হল ধর্মীয় সম্প্রীতি । আমরা সাংবিধানিক নীতিগুলিতে বিশ্বাস করি ৷ রাজ্যগুলির বহুত্ববাদের ভিত্তিতে তাদের অধিকারে বিশ্বাস করি এবং জনগণের মুখোমুখি হয়ে মৌলিক সমস্যাগুলির উপর ফোকাস করছি ।
সেই হিসেবে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের কৌশল হল নির্বাচনী ময়দানে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করে এমন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করা ৷ আর জনগণের বিশাল সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করা এবং জয়ের সম্ভাবনার উপর নির্ভর করে শরিকদের মধ্যে আসন বণ্টন নিশ্চিত করা । সাম্প্রতিক উপনির্বাচন এবং কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন কীভাবে জয় সম্ভব হয়েছে, তা আপনরা দেখেছেন ।
প্রশ্ন: ডিএমকে কি জাতীয় রাজনীতিতে শক্তিবৃদ্ধি করতে চাইছে ? আপনার বক্তৃতা হিন্দিতে প্রকাশিত হচ্ছে, যেমন আগে কখনও হয়নি । আপনি কি প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন ?
স্ট্যালিন: ডিএমকে ইতিমধ্যেই জাতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় বৃহত্তম দল । 40 বছরেরও বেশি সময় ধরে নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থেকে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে ৷
কালাইনার (এম করুণানিধি) ব্যাংক জাতীয়করণ-সহ প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির প্রগতিশীল পদক্ষেপগুলিকে সমর্থন করে জাতীয় রাজনীতিতে দলকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ৷ জরুরি অবস্থার সময় তিনি গণতান্ত্রিক স্বরের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা উত্তর ভারতের নেতাদের জন্য তামিলনাড়ুতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল ৷ এটা অন্য কোনও রাজ্য করেনি ।
ডিএমকে ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের চ্যাম্পিয়ন ভিপি সিংয়ের ন্যাশনাল ফ্রন্ট সরকারের মেরুদণ্ড । এই দল অনগ্রসর শ্রেণির জন্য 27 শতাংশ সংরক্ষণ বলবৎ করে সারা দেশে সামাজিক ন্যায়বিচারের শিখা প্রজ্বলিত করতে সহায়তা করেছে ।
একটি সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচির মাধ্যমে এই দল বাজপেয়ী সরকারকে সমর্থন করেছিল ৷ এই প্রশংসা পেয়েছিল যে যখন ডিএমকে থাকবে, তখন সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান থাকবে না । ডিএমকে নিশ্চিত করেছিল যে একটি জোট সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ চালাতে পারে ৷ এর ফলে কেন্দ্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরিতে সহায়তা হয়েছিল ।
ডিএমকে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের দু’টি ইউপিএ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল । রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ডিএমকে-র অবস্থান সফল হয়েছে এবং জাতীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সোশাল মিডিয়া-সহ অনেক উপায়ে ডিএমকে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকের কাজকর্মে অবদান রাখছে ।
"আমি আমার উচ্চতা জানি", আমাদের নেতা কালাইনার এই কথা বলেছিলেন এবং এমকে স্ট্যালিনও তাঁর উচ্চতা খুব ভালো করেই জানেন ।
প্রশ্ন: কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিটি নতুন বিলের নামকরণ করছে হিন্দিতে । এমনকি আগের আইনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে হিন্দিতে । হিন্দি আধিপত্যের বিরোধিতার জন্য পরিচিত ডিএমকে এবং তামিলনাড়ুর প্রতিক্রিয়া কী হবে ?
স্ট্যালিন: ডিএমকে সাংসদরা এই বিষয়টি সংসদের উভয় কক্ষে উত্থাপন করেছেন । হিন্দিতে আমন্ত্রণপত্র ছিঁড়ে তাঁরা তাঁদের প্রতিবাদ নথিভুক্ত করেছেন ।
ডিএমকে ধারাবাহিকভাবে বিজেপির 'এক জাতি, এক ভাষা'-এর লুকানো প্রকল্পের বিপদের ওপর জোর দিয়ে আসছে ৷ যা শুধুমাত্র তামিল নয়, অন্যান্য রাজ্যের সব ভাষার জন্যই ক্ষতিকর । অন্যান্য রাজ্যেও এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে ।
আমরা কোনও ভাষার বিরোধী নই । কিন্তু, আমরা যেকোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার দৃঢ় বিরোধী এবং এই অবস্থান অব্যাহত রয়েছে । লোকসভা নির্বাচনের পর নতুন সরকার সব ভাষাকে সমান মর্যাদা ও গুরুত্ব দেবে ।
প্রশ্ন: ওয়াশিংটন পোস্ট বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের জন্য সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার করার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে । এটা কি শুধুমাত্র ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করার কৌশল নাকি ক্ষমতার অপব্যবহার ? আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী ?
স্ট্যালিন: বিজেপি ভুয়ো প্রচারের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির নাম পেয়েছে । ডিজিটাল থেকে টেলিভিশন এবং প্রিন্টকে পর্যন্ত নিজেদের টানতে বিজেপি সরকার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ৷ ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ করেছে যে সোশাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও এটি রয়েছে । তাই ‘ইন্ডিয়া’ ব্লক যে সঞ্চালক-সঞ্চালিকাদের বয়কট করেছে, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার প্রকাশ করার জন্য । উদ্দেশ্য হল, সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমে নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা । ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি অপপ্রচার ও অপবাদ মোকাবিলায় ‘ইন্ডিয়া’ ব্লক একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে আসছে ।
প্রশ্ন: ইন্ডিয়া ব্লকের বর্তমান অবস্থা কী ? ব্লকের সমন্বয়কারী চালিকাশক্তি কী ?
স্ট্যালিন: কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন এবং সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের মাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া’ ব্লক প্রথম রাউন্ডে সাফল্য পেয়েছে । বিজেপির ন’বছরের গণতন্ত্রবিরোধী, জনবিরোধী ও সংবিধানবিরোধী শাসন ‘ইন্ডিয়া’ ব্লককে একত্রিত হতে সাহায্য করেছে । বিজেপির ‘বন্ধু’ এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট এবং অন্যান্যদের মধ্যে আয়কর বিভাগ, আরও দলকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে আনবে ৷ সংবিধান ও সংবিধানের মূলনীতির পাশাপাশি জনগণই আমাদের জোটের চালিকাশক্তি ।
প্রশ্ন: মন্দিরগুলিকে হিন্দু রিলিজিয়াস অ্যান্ড চ্যারিট্যাবল এনডাউমেন্টস (এইচআরঅ্যান্ডসিই) বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকার সমালোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । এই নিয়ে তামিলনাড়ু সরকারের প্রতিক্রিয়া কী ?
স্ট্যালিন: ডিএমকে ক্ষমতায় আসার পরে 1118টি মন্দিরে পবিত্রতা সম্পাদিত হয়েছে । এখনও পর্যন্ত এইচআরঅ্যান্ডসিই বিভাগে 5473 কোটি টাকা দামের 5820 একর জমি উদ্ধার করেছে । প্রধানমন্ত্রী এটা না জেনেই কথা বলেছেন এবং আমি এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছি ।
এখন বিজেপি সরকারের অধীনে কী হচ্ছে ? তারা এইমস হাসপাতাল তৈরি করতে পারেনি । তারা এনইইটি ছাড় বিলে সম্মতি দিতে পারেনি ।
রাজ্যের আর্থিক অধিকার এবং রাজ্যের অধিকার দেওয়া হয় না ।
যে ব্যক্তি রাজ্য সরকারের কোনও সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করেন, যিনি রাজনৈতিক বক্তৃতায় লিপ্ত হয়ে সরকারি অফিসের অবমাননা করেন, তাঁকে রাজ্যপাল হিসাবে রাখা হচ্ছে । এবং এটা তামিলদের ও তামিলনাড়ুর উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে ৷ যার ফলে আমাদের যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে ।
ন’বছরের শাসনে তামিলনাড়ুর জন্য বিজেপি সরকারের কোনও কৃতিত্ব নেই । কোনও বিশেষ প্রকল্প নেই । তাই পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ভোট চাইতে সমস্যা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর । বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য তিনি এইচআরঅ্যান্ডসিইকে টার্গেট করছেন ৷ এই বিভাগ প্রশংসনীয় কাজ করছে ।
প্রশ্ন: চলতি বছরে কাবেরী নদীর জলের ঘাটতি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ব-দ্বীপ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য সমাধান কী ? রাজনৈতিক সমাধান কি সম্ভব ?
স্ট্যালিন: শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক সমাধান অধরা ছিল বলে কাবেরী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল । চূড়ান্ত রায়েও তা বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট । কাবেরী ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি এবং সর্বোচ্চ আদালতের কাছে গিয়ে ব-দ্বীপ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য জল সুরক্ষিত করা হয়েছে ৷ আমার সরকার কাবেরী নদীর জলের বিষয়ে ব-দ্বীপ অঞ্চলের কৃষকদের এবং তামিলনাড়ুর অধিকার রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ।
প্রশ্ন: আদমশুমারিতে জাতি গণনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আপনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন । কিছু নেতা দাবি করছেন যে রাজ্য সরকার নিজেই জাতি সমীক্ষা করুক । তামিলনাড়ু সরকারের জাতি সমীক্ষা করার সম্ভাবনা আছে কি ?
স্ট্যালিন: তামিলনাড়ু 69 শতাংশ সংরক্ষণ প্রদান করে । জনগণনার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় এবং সেই কারণেই ডিএমকে যে সরকারের অংশীদার ছিল, সেই ইউপিএ সরকার 2011 সালে জাতিভিত্তিক গণনা শুরু করেছিল । বিজেপি সরকার সেই গণনার ফলাফল প্রকাশ করেনি । এই নিয়ে 2015 সালে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হলেও আজ পর্যন্ত ওই প্যানেলের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি ।
মণ্ডল কমিশনই অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য শিক্ষা ও চাকরিতে 27 শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল । একইভাবে, আদমশুমারির অংশ হিসাবে জাতিগণনা শুধুমাত্র তামিলনাড়ুর জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে । এই কারণেই এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি ।
প্রশ্ন: বিজেপি-এআইএডিএমকে জোট কি সত্যিই ভেঙে গিয়েছে ? জোটের হিসাব-নিকাশের কি কোনও পরিবর্তন হবে ?
স্ট্যালিন: একটি রাজ্যে বিজেপির এক শরিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পর কী হচ্ছে, তা আপনি নিশ্চয় জানেন এবং আপনি এআইএডিএমকে ও বিজেপির মধ্যে বিচ্ছেদও দেখছেন । তারা আসলে আলাদা হয়ে গিয়েছে কি না, তা নিয়ে আপনারও সন্দেহ আছে । আমরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না ।
মানুষ বিজেপি শাসনের অরাজকতা এবং এআইএডিএমকে-র অধীনে বিশৃঙ্খলা দেখেছে । তারা এমন একটি সরকারকে প্রত্যক্ষ করছে, যারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণের কৃতিত্বের জন্য জন্য অনেক কিছু করছে ৷ আমাদের সুশাসনে বিশ্বাস রেখেই আমরা নির্বাচনে অংশ নিই । গত আড়াই বছরে, আমরা এআইএডিএমকে 10 বছরের সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে সংশোধন করেছি ৷ রাজ্যকে শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পরিচালনা করছি । ডিএমকে-র সুশাসন এবং শরিকদের সদিচ্ছার ভিত্তিতে আমরা জনগণের কাছে যাব । জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে ।