গত বছর কোভিড 19 এর প্রথম তরঙ্গের আঘাতে দেশটি জীবন - জীবিকার দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল । ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের ফলে লকডাউনের জন্য কর্মসংস্থানের হারও নিম্নমুখী । 2020 সালের 13 মে দেশের অর্থনৈতিক চাপ লাঘব করার জন্য কুড়ি লাখ কোটি টাকার আত্মনির্ভর প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার । মূলত এটি করা হয়েছিল, ব্যাঙ্কগুলির কাছে নগদ অর্থ মজুত করার তাগিদে । যাতে ছোট, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প গুলি এবং রাস্তার হকাররা সহজে ব্যাঙ্ক থেকে নগদ অর্থ পেতে পারে । এর গ্যারেন্টার থাকবে সরকার । পাশাপাশি কৃষি পরিকাঠামোতে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল । একই সঙ্গে কৃষি, শিল্প এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে সমতা আনার লক্ষ্যে সংস্কারের কথাও বলা হয়েছিল । অন্যদিকে, পিএসইউ-তে বেসরকারি খাতের প্রবেশকে সহজতর করার কথা বলা হয়েছিল ।
কিন্তু, এই প্যাকেজের সুবিধাগুলি ভোগ করার আগেই পুরো বিষয়টাই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল । কোভিড 19 এর দ্বিতীয় তরঙ্গ দেশটাকে যেন আরও বেশি করে ভয়ঙ্করতার দিকে ঠেলে দিয়েছে । সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । 1952 সালের পর ভারতীয় অর্থনীতি সব থেকে বড় সঙ্কটের মুখোমুখি । অন্যদিকে, বিশ্ব জুড়ে বিশেষজ্ঞরা চলতি অর্থবছরে জন্য তাদের পূর্বাভাস প্রকাশ করেছেন । এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিং 11 শতাংশ থেকে 9.8 শতাংশে নেমে এসেছে, ফিচ সলিউশন 9.5 শতাংশের কথা বলছে, ব্লুমবার্গ 11 শতাংশের আভাস দিয়েছে । অর্থনৈতিক বিকাশের এই নিম্নমুখী হার নিঃসন্দেহে বেকারত্বের দিকেই আঙুল নির্দেশ করছে । আর স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতির পতনের কথা বলছে । কোভিড 19 এর দ্বিতীয় তরঙ্গে সব থেকে ভয়ঙ্করভাবে আঘাত প্রাপ্ত দেশের নাম ভারত । আমরা স্বাধীনতার পর সব থেকে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছি । গত বছর এই সময় আমরা যে জায়গায় ছিলাম, ঠিক এক বছর পর আমরা সেই জায়গাতেই আছি । বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ খুঁজতে হবে ।
আরও পড়ুন : আগামী সপ্তাহেই ভারতে মিলবে স্পুটনিক-5 টিকা, দাবি নীতি আয়োগ সদস্যের
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আত্মনির্ভর ভারতের ধারণাকে পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে । যেহেতু দেশ একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে, কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, সেজন্য শীঘ্রই সমস্যার সমাধান করতে হবে । যখন আত্মনির্ভর ভারতের কথা আসে, তখন ঋণ ছাড়ের সুযোগ দিয়ে উৎসাহ প্রদানের প্রসঙ্গ সামনে আসে । এক্ষেত্রে নজর দেওয়া উচিত সেই ব্যবসাগুলির দিকে, যেগুলি ঋণ শোধের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী । আমরা এমন একটা সময় দিয়ে চলেছি, যখন অর্থনীতির অনিশ্চয়তার কারণ পণ্য-পরিষেবা খাতেও বিরূপ প্রভাব পড়ছে । অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এক দিকে যেমন বিশেষ প্যাকেজ দরকার তেমনই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে ।
চ্যালেঞ্জ
এই মুহূর্তে আমাদের কাছে প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনীতির চাহিদা পূরণ করা । তাকে চাঙ্গা করা । পরিস্থিতি ক্রমশ বেকারত্বের দিকে আঙুল নির্দেশ করছে । কোভিড 19 এর কারণ বেশির ভাগ রাজ্য বিধিনিষেধের কড়াকড়ি করেছে, লক ডাউনের পথে গিয়েছে । এর ফলে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কর্মসংস্থান আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে । দ্বিতীয় তরঙ্গটি আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে গভীর অসমতা তৈরি করেছে । কোভিড 19 এর প্রথম তরঙ্গ যে ক্ষত তৈরি করেছিল, তা সেরে ওঠার আগেই দ্বিতীয় ধাক্কা ক্ষতকে আরও গভীর এবং প্রশস্ত করল । আমরা প্রথম তরঙ্গের সময় দেখতে পেয়েছি, হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ চাকরি হারিয়েছেন । তাদের সঞ্চয় মারাত্মক ভাবে হ্রাস পেয়েছে । কিন্তু, সেই সময় খুব অল্প সংখ্যক সংস্থার বিকাশ ঘটেছিল । ছবিটা শুধু প্রথম তরঙ্গের সময়ই ছিল না, প্রথম তরঙ্গ কেটে যাওয়ার পরও তার রেশ থেকে গিয়েছিল । দ্বিতীয় তরঙ্গটি চলে যাওয়ার পরও সেই একই ছবি আবারও দেখা যাবে, যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দ্রুততার সঙ্গে না নেওয়া হয় । আর আমাদের কাছে তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি হল, গ্রামীণ মজুরিতে স্থবিরতা এবং গ্রামে চাহিদা হ্রাস । ভারতের মতো দেশে শিল্প বিশেষ করে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পগুলির মূল চাবিকাঠি গ্রামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে । কৃষি এবং ক্ষুদ্র - মাঝারি শিল্প যৌথ ভাবে দেশের প্রায় 80 শতাংশ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করে । এই সেক্টরগুলির পুনরুজ্জীবন দেশের অর্থনীতিকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি ।
এগিয়ে যাওয়ার পথ
গ্রাহকের চাহিদা বৃদ্ধি, তাদের হাতে নগদ অর্থের জোগান ( কোনও ভাবেই ঋণ নয় ) - ই একমাত্র পারে এই সমস্যা থেকে রক্ষা করতে । বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে ছোট এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলিকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহ তৈরি করা যেতে পারে । মনরেগা প্রকল্পের পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রের জন্য আরও বেশি পরিমাণ বরাদ্দ করা জরুরি । যাতে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যোগানের পরিমাণ বাড়ানো যায় । চাহিদা বৃদ্ধি পেলেই জোগান বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত । আয়ের বৈষম্য হ্রাসের পাশাপাশি বর্তমান কর্মচারী এবং নতুন নিয়োগ হওয়া কর্মচারীর মধ্যে মজুরিগত ভারসাম্য প্রদান এবং ভর্তুকির বিষয়টা বিবেচনা করা উচিত । এ জাতীয় পদক্ষেপই একমাত্র কাজকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে এবং প্যানডেমিক চলাকালীন কর্মীদের আয় সুনিশ্চিত করবে । এর ফলেই আয়ের বৈষম্যকে হ্রাস করা সম্ভব হবে ।
আরও পড়ুন :একুশের শেষে ভ্যাকসিনের 200 কোটি ডোজ় থাকবে ভাঁড়ারে, দাবি কেন্দ্রের
অন্যদিকে, দরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া মানুষদের হাতে নগদের পরিমান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন । কারণ এই শ্রেণীর মানুষরা দিনে যে পরিমাণ টাকা আয় করেন, তার সিংহ ভাগই সে দিনের অন্ন সংস্থানের জন্য ব্যয় করতে বাধ্য হন । কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্প উভয় খাতেই উৎপাদন বৃদ্ধির একমাত্র পন্থা আয়ের জোগান । আর সেটা হলেই একমাত্র উৎসাহ বাড়ানো সম্ভব । সুতরাং সবার প্রথম এই আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন । একটা কথা মনে রাখতে হবে, কোনও একটা গোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার উন্নতি বড় হতে পারে না । কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত । আর তার ফলেই দেশ একমাত্র স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে ।