হায়দরাবাদ: ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়ে গিয়েছে তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মিজোরামের ভোটের নির্ঘণ্ট ৷ আগামী মাসে বিধানসভা ভোট এই পাঁচ রাজ্যে ৷ ফল প্রকাশ আগামী 3 ডিসেম্বর ৷ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে ইতিমধ্যেই এই পাঁচ রাজ্যে জারি হয়ে গিয়েছে আদর্শ আচরণ বিধি ৷ অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কমিশন ৷ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার জোর দিয়েছেন, কোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা থাকলে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সেই তথ্য জানানোর উপরে ৷
এছাড়াও বেশকিছু প্রস্তাব দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের তরফে রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি দেওয়া হয়েছে ৷ যার মধ্যে অন্যতম হল, ফৌজদারি অপরাধের কোনও মামলায় অভিযুক্তকে প্রার্থী করা হলে, কেন সেই ব্যক্তিকে প্রার্থী করা হল সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হবে সংশ্লিষ্ট দলকে ৷ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলগুলির যাতে দায়বদ্ধতা প্রতিফলিত হয়, তা নিশ্চিত করতেই এই প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন ৷ প্রত্যাশিত না-হলেও বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি রীতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, বহু রাজনীতিকের বিরুদ্ধেই ফৌজদারি অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ রয়েছে ৷ এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত কমিশনও ৷
সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস বা এডিআর (ADR) ৷ লোকসভা ও রাজ্যসভার 763 জন সাংসদের নির্বাচনী শংসাপত্র বিশ্লেষণের পর এই সংস্থাটির তরফে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, এই সাংসদদের মধ্যে 40 শতাংশ অর্থাৎ 306 জনের বিরুদ্ধেই রয়েছে ফৌজদারি মামলা বা অপরাধের মামলা ৷ এদের মধ্যে 194 বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর উপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ ৷ ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এই প্রবণতা বিপজ্জনক বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে ৷
তথ্য বলছে বছরের পর বছর ধরে ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্তদের আইনসভার সদস্য হওয়ার উদাহরণ বাড়ছে ৷ 2019 লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়া সাংসদদের মধ্যে 233 জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্রিমিনাল কেস ৷ 2004 সালে এই সংখ্যা ছিল 128 ৷ আরও আশ্চর্যজনক হল, দেশের প্রায় 4 হাজার বা 44 শতাংশ জনপ্রতিনিধির অতীত কাজকর্ম নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে ৷ দুর্নীতি, খুনের মতো ঘটনায় অভিযুক্তরা যেভাবে আইনসভার সদস্য হয়ে যাচ্ছেন তাতে দেশের ভবিষ্যত ও আইনসভার মান নিয়েই চিন্তার অবকাশ তৈরি হচ্ছে ৷
আরও পড়ুন: আগুন নিয়ে খেলছে কানাডা, ক্রমেই চরমপন্থীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে ট্রুডোর দেশ
এইসব কারণে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস তৈরি হলে তা আইনসভার সম্মানের পক্ষে ক্ষতিকারক তো বটেই, ক্রমে তা একনায়কতন্ত্র বা নৈরাজ্যের পথে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে দেশকে ৷ দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে যেভাবে ক্রমশ দুর্বৃত্তরা খমতাশালী হয়ে উঠছেন সেই পরিস্থিতির সঙ্গেই বর্তমানে যুঝতে হচ্ছে দেশকে ৷ বর্তমানে প্রচলিত নিয়ম মেনে দোষীসাব্যস্ত হওয়া কোনও জনপ্রতিনিধিকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া যে এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয় তারও প্রমাণ মিলেছে ৷ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে ৷
এই সমস্যার সমাধানে দেশের আইন কমিশন বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে ৷ যারমধ্যে অন্যতম হল, 5 বছরের বেশি সাজা হতে পারে এমন গুরুতর ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হওয়ার পরেই তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে ৷ তবে এই নিয়মের যাতে অপব্যবহার না হয় সেই দিকটিও মাথায় রাখা প্রয়োজন ৷ এছাড়াও, বর্তমানে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও অর্থের ব্যবহারের পাশাপাশি ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভোট কেনার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে ৷ গণতন্ত্রের পক্ষে এই বিষয়গুলি কর্কট রোগের মতোই বিপজ্জনক ৷ কমিশন সরাসরি না বললেও, এই ভোট কেনার বিষয়টি যে দেশের গণতান্ত্রিক ভিতের পক্ষে কাম্য নয়, তা বলা যায় ৷
মতাদর্শ নির্বিশেষে কমবেশি দেশের সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এই ভোট কেনার বিষয়টি লক্ষণীয় এবং এই ধরণের সংস্কৃতির কু-প্রভাব সুদুরপ্রসারী ৷ তা দেশের পক্ষে ক্ষতিকারকও বটে ৷ তাই দেশ ও দশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলির উচিত অর্থের বিনিময়ে এই ভোট কেনা থেকে বিরত থাকা ৷ অন্যথায়, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা ও তার শুদ্ধতা বজায় রাখা সম্ভব না, সেক্ষেত্রে ভোট প্রক্রিয়া একটি ফাঁপা বিষয় হয়ে পড়ে থাকবে, যার সঙ্গী হবে দুর্নীতি ৷ আরও কঠোরভাবে জনপ্রতিনিধিত্ব আইন বলবতের উপর আগেও সওয়াল করেছে নির্বাচন কমিশন ৷ আর এই স্বপ্ন সফল করতে এই আইনে সংশোধন এখন সময়ের দাবি ৷ ভোটে জেতার জন্য দলগুলির মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রবণতাও এক্ষেত্রে দুঃখের বিষয় ৷ এই কাজ করে ক্ষমতা দখল করা গেলেও আদতে তা ভোটারদের ঠকানোই হয় ৷
তাই সবদলেরই উচিত, কোন সময়ের মধ্যে তারা প্রতিশ্রিুতি পূরণ করবে তা ইস্তাহারে উল্লেখ করা ৷ প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রেও আইনি ব্যবস্থা থাকা উচিত ৷ ভোট জিতে একবার ক্ষমতা দখল করলেই সব হয়ে যাবে, এই ধারণা বদলের প্রয়োজন ৷ এসবের পরিবর্তন না হলে দেশ খারাপ রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্তি পাবে না ৷ সত্যিকারের গণতন্ত্র তখনই প্রস্ফুটিত হবে যখন ভোটারদের বিশ্বাস জেতা ও তাঁদের দাবি সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হবে ৷
(ইনাডু সম্পাদকীয়, 3 অক্টোবর প্রকাশিত)