দিল্লি, 9 অগাস্ট: আজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের 78 তম বর্ষপূর্তি । 1942 সালের 9 অগাস্ট মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে এই আন্দোলনের সূচনা হয় । দেশবাসীকে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান গান্ধিজি । তাঁর এই আন্দোলনের সঙ্গী ছিলেন বহু বিশিষ্ট নেতা । মিলিতভাবে দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তা দিলেন ব্রিটিশদের দেশ ছাড়া করতে প্রতিবাদই এখন এক মাত্র অস্ত্র ।
অগাস্ট ক্রান্তি বা ভারত ছাড়ো আন্দোলন:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন । ভারতের সমর্থনও পেয়েছে ইংল্যান্ড । কিন্তু তবুও ভারত ছাড়তে রাজি নয় ব্রিটিশরা । পরাধীনতার বেড়ি পায়ে পায়ে বেড়েই চলেছে । ঠিক এমনই সময় বাপু (মহাত্মা গান্ধি) ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন । 1942 সালের 4 জুলাই । দেশ থেকে ব্রিটিশদের বহিষ্কার করতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সংসদে একটি প্রস্তাব পাশ করায় । এদিকে সি রাজা গোপালাচারী কংগ্রেস ছেড়েছেন । কিন্তু নেহরু ও মৌলনা আজ়াদ সমর্থন করলেন গান্ধিজিকেই । 1942 সালের 8 অগাস্ট বোম্বে অধিবেশনে কংগ্রসের দ্বারা পাশ হয়ে গেল ভারত ছাড়ো আন্দেলন বিল । কিন্তু ব্রিটিশ সরকারে আগ্রাসনের মুখে পড়লেন গান্ধিজি । পুনের আগা খান প্যালাসে বন্দী করা হল তাঁকে । প্রায় সব নেতাই তখন কারাগারে রয়েছেন । জেলের বাইরে রয়েছেন একমাত্র অরুণা আসাফ । 1942 সালের 9 অগাস্ট মুম্বইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক গ্রাউন্ডে ভারতের পতাকা উত্তোলন করলেন তিনি । সূচনা হল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের । আন্দোলনে গান্ধিজি স্লোগান দিলেন, "করব নয় মরব"।
ব্যর্থ হল ভারত ছাড়ো আন্দোলন:
ভয় পেল ব্রিটিশরা । কারাবন্দী করা হল মহাত্মা গান্ধি-সহ কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতৃত্বকে । তাঁদের মধ্যে ছিলেন গান্ধিজি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেলের মতো কংগ্রেস নেতারা । 1945 সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত বেশিরভাগজনই বিনা বিচারে কারাবন্দী রইলেন । এছাড়াও জাতীয় কংগ্রেসকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হল । কংগ্রেসের প্রতিটা অফিসে হানা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করা হল তহবিল । এদিকে প্রধান নেতৃত্বরা গ্রেপ্তার হতেই আগুনে যেন ঘৃতাহুতি পড়ল । বাড়ল জনরোষ । চলতে থাকল লাগাতার আন্দোলন । কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব এই আন্দোলনের গতিকে আলগা করে দেয় । শেষ পর্যন্ত 1943 সালে ব্যর্থ হয় ভারত ছাড়ো আন্দোলন । ব্যর্থতা সত্ত্বেও আন্দোলনের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না । কোথাও যেন ব্রিটিশদের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে যায় এই আন্দোলের পর থেকেই । ব্রিটিশদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি ভারতীয়দের কায়েম করার দিন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে । ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাই ইতিহাসের পাতায় এই আন্দোলন তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচ্য ।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জড়িত প্রধান নেতারা:
মহাত্মা গান্ধি
আবদুল কালাম আজ়াদ
জওহরলাল নেহরু
সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ:
উষা মেহতা
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যুক্ত অন্যতম প্রধান নেত্রী উষা মেহতা । কংগ্রেসের রেডিয়ো ষড়ষন্ত্র মামলায় উঠে আসে তাঁর নাম । 'ভয়েস অফ ফ্রিডম' (স্বাধীনতার কণ্ঠ) নাম দিয়ে একটি রেডিয়ো অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে শুরু করেন । উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মধ্যে মুক্তি যুদ্ধের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া । 1942 সালের 12 নভেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত উষা ও তাঁর ভাই মিলে সম্প্রচার চালিয়ে যান । চার বছরের জন্য কারাবন্দী করা হয় উষাকে ।
অরুণা অসাফ আলি
সত্যগ্রহ আন্দোলনের সময়ে উঠে আসে অরুণার নাম । সাহসী অরুণার কার্যক্রমে ভয় পান দিল্লির চিফ কমিশনারও । রাষ্ট্রদোহিতার মামলা নয় বরং তাঁকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করে ব্রিটিশ সরকার । মুখ বন্ধ করার জন্য তাঁকে টাকার প্রলোভন দেখানো হয় । ব্রিটিশদের সমর্থন করলে নিরাপত্তা দানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল অরুণাকে । কিন্তু সেই প্রস্তাব একবাক্যে ফিরিয়ে দেন তিনি । এরপরই গ্রেপ্তার করা হয় অরুণাকে । এক বছর কারাবন্দী থাকেন তিনি।
সুচেতা কৃপানী
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেত্রী ছিলেন সুচেতা কৃপানী । তাঁর প্রথম কাজ ছিল ভারতেজুড়ে সক্রিয় গ্রুপগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখা । গ্রুপের সদস্যদের অহিংস আন্দোলনের সঙ্গে যু্ক্ত রাখা । 1944 সালে ধরা পড়ে যান তিনি । লখনউয়ের জেলে 'বিপজ্জনক বন্দী'-র তকমা দিয়ে বন্দী রাখা হয় তাঁকে । ভারত ছাড়ো আন্দোলন থেকে শুরু হয় মহিলাদের সক্রিয় প্রতিবাদ । ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে প্রতিবাদের রূপরেখা । একসময় যা ছিল সক্রিয় প্রতিবাদের মাধ্যমে আন্দোলন তাই পরবর্তী সময়ে অহিংস আন্দোলনে রূপ নেয় ।
সুশীলা নায়ার
পেশায় ছিলেন চিকিৎসক । গান্ধির সেক্রেটারি পেয়ারেলালের ছোটো বোন ছিলেন সুশীলা নায়ার । পরে তিনি গান্ধি ও কাস্তুবরা ব্যক্তিগত চিকিৎসক হন । কাস্তুরবা, গান্ধি ও মহাদেভভাইয়ের সঙ্গে তাঁকে আগা খান প্যালেসে কারাবন্দী করা হয়েছিল 1942 সালে ।
রাজকুমারী অমৃত কাউর
কাপুরথালা রাজ্যের রাজপরিবারে জন্ম রাজকুমারি অমৃত কাউরের । গান্ধির ভাবধারায় তাঁকে প্রভাবিত করেছিল । ধীরে ধীরে গান্ধিজির অনুগামী হয়ে ওঠেন তিনি । সত্যাগ্রহ আন্দোলন এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশ নেন সক্রিয়ভাবে । নারীশিক্ষা ও হরিজন শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য । তিনি অল ইন্ডিয়া ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসডিন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন । আন্দোলন চলাকালীন রাজকুমারী অমৃত কাউর মিছিল ও প্রতিবাদ সভার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন । 1942 সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকেও গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ সরকার । কালকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে ।