2011 সালে বড় পর্দায় মুক্তি পায় ‘কনটাজিওন’। ছবির শুরুতেই ছিল কালো স্ক্রিনে ভয়ঙ্কর কাশির আওয়াজ । মনে হয়েছিল, অবশেষে স্টিভন সোডারবার্গের কল্পনার ঘোড়া যেন দৌড়তে শুরু করল । ফিল্মটি মুক্তি পেয়েছিল 9 সেপ্টেম্বর, হোটা আমেরিকাকে নাড়িয়ে দেওয়া 9/11-এর সেই ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদি হামলার ঠিক 10 বছর পর । এই ফিল্মে দেখানো হয়েছিল ফাঁকা বিমানবন্দর, আবর্জনা ভর্তি রাস্তা, বিভিন্ন দোকানে আতঙ্কিত ক্রেতার ভিড় । এবং দেখানো হয়েছিল এমন এক সংক্রমণ, যা চিন থেকে এসেছে এবং স্রেফ ছুঁলেই যা ছড়িয়ে পড়তে পারে । সেখানে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের কিছু দৃশ্য ছিল, যখন কোনও মায়ের আদর বা প্রেমিকের চুম্বন থেকেই হতে পারে মৃত্যু । আর আজ, আপনি কাউকে ফোন করুন, আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি থাকবে ভয়ঙ্কর কাশি । আপনি যদি কোনও দোকানে বা বাজারে জিনিসপত্র কিনতে যান এবং সেখানে যদি কোনও নির্দেশিকা না লেখা থাকে, তা হলে মালপত্র কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ক্রেতাদের মধ্যে । শেষ কবে কেউ বিমানবন্দরে গিয়েছেন, তা মনে করাই কঠিন । আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টি হল, এই রোগের এখনও কোনও প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই । নেই সঠিক চিকিৎসার বিধিও ।
তবে বিষয়টি যখন হলিউডি হয়, তখন ফিল্মের সঙ্গে বাস্তবের অনেকটাই ফারাক থেকে যায় । 1995 সালে হলিউড ডাস্টিন হফম্যান ও মর্গান ফ্রিম্যানকে পাঠিয়েছিল এক শহরকে বাঁচাতে, যেখানে মারণ ফ্লু শহর উজাড় করে দিচ্ছে এবং যা মানব সভ্যতার অস্তিত্বের পক্ষে চরম সঙ্কট ডেকে আনতে পারে । 2015 সালে ‘ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড’-এ হলিউড তৈরি করল জলহীন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি যখন জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বকে গ্রাস করে নিয়েছে । এই হলিউডই আবার 2018 সালে মার্গারেট অ্যাটউডের ‘দ্য হ্যান্ডমেডস টেল’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করে ফেলল একটি ফিল্ম, যেখানে এক উন্মাদ প্রেসিডেন্ট নিজের খুশিতে পারলে সংবিধানও পাল্টে ফেলছেন ।
হলিউড সব সময়ই আমাদের মনের গভীরে থাকা ভয় ও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নকে খোঁচা দিয়েছে । তাই এই তথ্য একেবারেই চমকে দেয় না যে, হলিউডের বিশ্ব জুড়ে বার্ষিক আয় যেখানে 42 বিলিয়ন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় 3 লাখ 20 হাজার কোটি টাকার, সেখানে আমেরিকার বাইরে থেকে তাদের আয় 30 বিলিয়ন ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় দু’লাখ 29 হাজার কোটি ডলার। আর এই আয়ের বণ্টন থেকেই বোঝা যাচ্ছে, আক্ষরিক অর্থেই এরা কতটা আন্তর্জাতিক সুপার পাওয়ার । আমাদের মনের গভীরে থাকা ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তাকে টেনে বের করে এনে তাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তোলার বিষয়টাকে হলিউড শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে । 2016 সালে মুক্তি পাওয়া মেক্সিকোর প্রবাদপ্রতিম পরিচালক আলফনসো কুয়ারনের সিনেমা ‘চিলড্রেন অব মেন’ ফিল্মটির কথাই ধরা যাক । এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে এমন এক ভাইরাসকে, যা বিশ্বের সব মহিলার প্রজননের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে । ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আর কোনও আশা নেই । সেই সময়ই এক মহিলা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন । উন্মত্ত জনতার হাত থেকে যাঁকে রক্ষা করে নিরাপদে নিয়ে যেতেই হবে ।
2002 সালের সিনেমা ‘28 ডেজ লেটার’-এর বিষয়বস্তু ছিল রাগ । আগামী দিনের রহস্যময় এক পৃথিবীতে কোমায় থাকা সিলিয়ান মার্ফি সজ্ঞানে এসে দেখেন, মানুষ এক ভয়ঙ্কর ভাইরাসের শিকার, যার ফলে রাগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে । 2008 সালে সারামাগোর দুর্দান্ত উপন্যাসের অনুকরণে তৈরি সিনেমা ‘ব্লাইন্ডনেস’-এর মূল ভিত্তিও ছিল রাগ, যেখানে বিশ্ব এক ভাইরাসের আক্রমণে দেরবার যা সবাইকে অন্ধ করে দিচ্ছে । এখানেও, সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করতে হয়েছে মহিলাদেরই, যেখানে খাবারের দায়িত্বে থাকা অন্ধ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁকে যৌন সম্পর্ক করতে হয়েছে খাবার পাওয়ার জন্য।
আজকের দিনে মানবতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে । নির্বাচিত নেতাদের কোনও রকম সহমর্মিতা নেই । কখনও জাত, কখনও লিঙ্গ বৈষম্যকে সামনে এনে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরির জন্য তাঁরা সচেষ্ট । এই অবস্থায় ফিল্মে ভিলেনদেরও চরিত্রের বদল হয়েছে । সেখানে এখন শক্তিশালী সরকার যুদ্ধ বাধাচ্ছে বা কোনও জঙ্গি সংগঠন মৃত্যুর কারণ হচ্ছে । এমনকী সিনেমা প্রস্তুতকারকরা এখন এটাও বুঝে গিয়েছেন যে, আমাদের সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা হল আমরা নিজেরাই ।
কিন্তু প্যানডেমিক নিয়ে হওয়া ফিল্মগুলোর বক্তব্য খুব স্পষ্ট— এই সব মহামারী যেমন আমাদের নিজেদের মধ্যে শত্রুর সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেয়, তেমনই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা অবস্থাতেও আমাদের কাছাকাছি এনে দেয় । অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে কেউই একা লড়াই করতে পারে না । এর জন্য প্রয়োজন টিমওয়ার্ক আর পারস্পরিক সহযোগিতা । অপ্রাসঙ্গিক নীতির কোনও মূল্যই নেই । ধরে নেওয়া যাক, রোগ সেরে গেল কিন্তু মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় মারা গেল, তা হলে কিন্তু যুদ্ধ জয় সম্ভব হবে না । সেটা সব দিক থেকেই হবে মানবতার হার । দেশের অন্যতম সেরা ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিলের কথায়, “এই ভাইরাস গরিবকেও যেমন আক্রমণ করবে, ধনীদেরও তেমনই আক্রমণ করবে । এর কাছে রাজা আর প্রজার কোনও পার্থক্য নেই । এক দিক থেকে দেখতে গেলে, এই ভাইরাস যেন রোগের ক্ষেত্রে সাম্য এনে দিয়েছে । জাত, লিঙ্গ, ধর্ম, আর্থিক অবস্থান, কোনও কিছুই দেখে না এই ভাইরাস ।”
2019 সালে আশিক আবুর মালয়ালম ফিল্ম ‘ভাইরাস’ ঠিক এই কথাগুলোই বলেছে । মালয়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সেরা অভিনেতাদের নিয়ে তৈরি এই সিনেমা তৈরি হয়েছিল নিপা সংক্রমণ নিয়ে । কেএস শৈলজা টিচার (ফিল্মে যিনি সিকে প্রমীলা এবং যে ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রেবতী) থেকে কোঝিকোড় হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স থেকে আমলাদের ভুমিকা এই ফিল্মে খুব সুন্দর করে দেখানো হয়েছে । বোঝানো হয়েছে, সজাগ জন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কীভাবে আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে । একসঙ্গে কাজ করার ক্ষমতার বিষয়টিও এখানে দেখানো হয়েছে । কিছুটা দেরি করে হলেও এই বিষয়টি এখন ভারতও বুঝতে পারছে । রাজ্য সরকারগুলি এখন অসরকারি সংগঠন, কর্পোরেট থেকে একক ভাবে কাজ করা মানুষদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছে ।
গত বছর যখন দীপা মেহতা নেটফ্লিক্সে তাঁর মিনি সিরিজ ‘লীলা’র প্রচার করছিলেন, যেখানে তিনি ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ছিলেন, বলেছিলেন, “আমরা এখন সবাই শালিনী ।” এই সিরিজে শালিনী এক জন স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত মহিলা যিনি ক্রমশ জলের সমস্যায় ভোগা বিশ্বে বাস করছেন এবং আমাদের মতো এভিয়ানের জল খাচ্ছেন এবং ভোগমাস্ক পরছেন । সিরিজটি তৈরি হয়েছে প্রয়াগ আকবরের একটি বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, যেখানে প্রকৃতির যুদ্ধের সঙ্গে মাতৃজঠরের যুদ্ধের তুলনা করা হয়েছে ।
‘লীলা’তে বিশ্ব আর আমাদের পরিচিত নয় । কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের কাছে এখনও কিছু সময় আছে ।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন কাবেরী বামজ়াই