এটা আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ । সীমাহীন যুদ্ধক্ষেত্রে এক অদৃশ্য শত্রুর (ভাইরাস) বিরুদ্ধে লৌহদৃঢ় মানসিকতা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ মানবতার লড়াই । ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহল, মানবসমাজের মিলিত শক্তি দিয়ে, প্রত্যেকটি নাগরিককে সৈনিক বানিয়ে কোরোনাকে প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে । এটা এই শতাব্দীর এমন একটা লড়াই, যা আগে কখনও শোনা যায়নি ! বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কোভিডকে মহামারী ঘোষণার আগেই এই সংক্রমণ ৪২৯১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, এবং ১১৪টি দেশে ১৮৪০০০ মানুষকে আক্রান্ত করেছিল ।
এটা এখন ১৮০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে ৩ লক্ষেরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে, এবং ১৩৭০০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে । বিশ্বায়ন এখন গোটা পৃথিবীকে গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত করেছে । বিমান যাতায়াত আশাতীতভাবে সম্প্রসারিত হওয়া, সর্বোচ্চ পাঁচটি পর্যটন দেশে পর্যটকদের আক্রমণ করেছে ভাইরাস, তাতে ভারতের পক্ষেও আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উহানে সংক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কার বিপদ বুঝতে পারেনি চিন, এবং তার জন্য তাঁদের ভারি মূল্য দিতে হয়েছে । এরপর তারা তাদের শক্তি সংহত করে একে নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয় । আবার দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানির মতো দেশ বেজিংয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়ে ভাইরাসের থেকে এককদম এগিয়ে রইল । অন্যদিকে ভাইরাস সহজভাবে নেওয়া ও দূরদর্শিতার অভাবের ভয়ানক ফল ভুগতে হয়েছে ইতালিকে । এমন একটা সময় যখন আমেরিকা ও ব্রিটেন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে, তখন ভাইরাসকে দ্বিতীয় ধাপেই রুখে দিতে বহুমুখী প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত । সারা ভারত জনতা লকডাউনের বিরাট সাফল্যের পর, মাসের শেষদিন পর্যন্ত বাতিল হয়ে গেছে ১১ হাজারেরও বেশি প্যাসেঞ্জার ট্রেন এবং আন্তঃরাজ্য বাস । তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশসহ বহু রাজ্য তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে । কোরোনা এমন একটা অসুখ, এই মুহূর্তে যার কোনও উপশম নেই । একজন থেকে অনেকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর উদ্বেগজনক হার এবং উপসর্গগুলো ভালোভাবে বুঝে নিয়ে, এর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়তে হবে সরকার, মেডিক্যাল পেশাদার, সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়াকে । এক শতক আগে বিশ্বের ১৫০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া স্প্যানিশ ফ্লু কত মানুষের মৃত্যু ডেকে এনেছিল, তা এখনও ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে । পরের দশকে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের আবিষ্কার এধরণের রোগের তীব্রতাকে কিছুটা প্রতিহত করেছে । কিন্তু ২০০৩-এর সার্স এবং ২০১৩-র মিডল ইস্ট ফ্লু আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল। এসবের বিপরীতে কোরোনা এই শতকের একটা মারণ রোগে পরিণত হয়েছে, যা বহু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে । চিনে সম্প্রতি শিল্প থাকায়, আপতকালীন মেডিক্যাল সামগ্রীর কম সরবরাহ বিপদে ফেলছে আমেরিকাকেও । ১৯৪১ সালে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছিল, কী করে এধরণের বিরাট সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হয় । আমেরিকার গাড়ি শিল্প দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গাড়ি তৈরি বন্ধ করে ঘণ্টায় দশটিরও বেশি ফাইটার জেট তৈরি করেছিল, এবং দেশকে জয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল । যখন এই আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে, যে ভারতে পরীক্ষা ব্যবস্থার খামতি রয়েছে, তখন বেসরকারি ক্ষেত্রকে কোরোনা পরীক্ষা করতে ICMR অনুমতি দেওয়াটা সঠিক দিশায় পদক্ষেপ ।
মহামারীর স্তরে পৌঁছনোর আগেই জনগণকে সচেতন করে কোরোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের মতো দেশের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । যেভাবে চিন দশদিনের মধ্যে হাজার শয্যার হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছে, এবং যেভাবে ডাক্তাররা শুধুমাত্র ডাইপার পরে দিন-রাত রোগীদের শুশ্রুষা করেছেন, সেটা নিঃস্বার্থ সেবা ও দক্ষতার এক অতুলনীয় উদাহরণ । ভাইরাস পরীক্ষাকেন্দ্রের কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম চিকিৎসক ও নার্সদের দিন-রাত কোভিড আক্রান্তদের সেবা করাটা একটা স্বর্গীয় উদ্যমের থেকে কম কিছু নয় । বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, কোভিডের ভ্যাক্সিন তৈরি হতে এখনও বছর দেড়েক সময় লাগবে । যখন আর মাত্র দু সপ্তাহের মধ্যেই ভারতে সংক্রমণ বিপজ্জনক তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছে, তখন এটাই সময় পুরো দেশ একজোট হয়ে, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে অশুভের মুখোমুখি হওয়ার ।
ভারতের পক্ষে এটা আক্ষরিক অর্থেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা । যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, যে একজন টিনএজারও কোরোনার কবল এড়াতে পারে না, সেখানে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলোকে একসঙ্গে মিলে একটা নিশ্ছিদ্র কর্মপদ্ধতি তৈরি করতে হবে। ভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধ করার একমাত্র লক্ষ্য নিয়ে, সরকার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী, মেডিক্যাল পরিষেবা ছাড়া সমস্ত প্রতিষ্ঠান লকডাউন করার নির্দেশ দিয়ে সমস্ত নাগরিকের বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করছে ।
দেশের ৫০ মিলিয়ন শ্রমিকের ৮৫ শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন । যখন সমস্ত সংস্থা, শিল্প এবং স্ব-রোজগারের উৎসগুলো বন্ধ, তখন তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ব্রিটেন যেখানে তাদের কর্মীদের বেতনের ৮০ শতাংশ বহন করতে তৈরি, ফ্রান্স তখন তাদের বড় সংস্থাগুলিতে রাষ্ট্রায়ত্ত করে বন্ধ হওয়া থেকে বাঁচাতে চাইছে। ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণা কর্মী ও কর্মসংস্থান তৈরি করা শিল্পগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি । হায়দরাবাদের মহিলাদের বিনা পারিশ্রমিকে স্যানিটাইজার ও মাস্ক তৈরি করা প্রশংসার যোগ্য । এমন একটা সময় যখন মহামারী নিয়ন্ত্রণে পুষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তখন পোলট্রি শিল্পের বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যে প্রচারের নিন্দা করা উচিত ! সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল, উপসর্গ দেখা গিয়েছে এমন রোগীদের সেলফ কোয়ারান্টাইনের জন্য সৎভাবে প্রস্তুত করা, যাতে তাঁরা এবং অন্যান্যরা নিরাপদে থাকেন । দক্ষিণ কোরিয়া GPS অ্যাপের মাধ্যমে কোরোনা রোগীদের যাতায়াতের এলাকা চিহ্নিত করতে সফল হয়েছে, এবং সেইসব এলাকাকে ভাইরাসমুক্ত করেছে । প্রযুক্তি, সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা, চিকিৎসদেক মহান আত্মত্যাগ এবং ইচ্ছুক মানুষের সহযোগিতার শক্তিকে হাতিয়ার করে, আসুন আমরা কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক যুদ্ধঘোষণা করি এবং জয়লাভ করি। আমাদের স্লোগান হোক: 'সবাই একের জন্য, সবার জন্য এক'।