সরায়কেলা, 30 জুলাই: ঘড়ি কাঁটায় তখন 3টে 35 বেজে গিয়েছে ৷ হাওড়া-মুম্বই সিএসএমটি এক্সপ্রেসের গতি তখন প্রায় 110 কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা ৷ ভোররাতে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যাত্রীরা ৷ ঝড়খণ্ডের চক্রধরপুর ডিভিশনে রাজখরসাওয়ান রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রায় 22 কিলোমিটার দূরে হঠাৎই তীব্র ঝাঁকুনি ৷ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শান্ত ৷ তবে, এর মধ্যে কামে ভেসে আসতে থাকে কান্না ও চিৎকারের শব্দ ৷
কী হয়েছে ? কেন এই চিৎকার ? কীসের কারণ এরকম তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে সব থেমে গেল ? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, হুগলির বলাগড়ের খামারগাছির মুক্তকেশি তলার বাসিন্দা শ্যামাপ্রসাদ হালদার ৷ তিনি ওই ট্রেনে এসি বি-2 কামরায় ছিলেন ৷ স্ত্রী অঞ্জনা হালদারের ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য, তাঁকে নিয়ে মুম্বইয়ের টাটা মেডিক্যাল সেন্টারে যাচ্ছিলেন ৷ ইটিভি ভারতকে ভয়াবহ এই রেল দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে, আঁতকে উঠছিলেন শ্যামপ্রসাদ হালদার ৷
তিনি বলেন, "তখন ভোর সারে তিনটে হঠাৎ ঝাঁকুনি আর প্রচণ্ড শব্দে ট্রেনের কামরা হেলে পড়ল ৷ আমরা B-2 কামারায় ছিলাম ৷ আমাদের ট্রেন হাওড়া থেকেই প্রায় 3 ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে ৷ তাই রাতে ট্রেনের গতিও বেশি ছিল ৷ ট্রেনের সকলেই প্রায় ঘুমাচ্ছিলেন ৷ হঠাৎই, বিকট শব্দ ও তীব্র ঝাঁকুনি ৷ সে সব থামার পর ধাতস্ত হতেই বেশ কয়েক মিনিট লেগে গিয়েছিল ৷ তার মধ্যে ট্রেনের আপার বাথে ছিলাম ৷ মাথায় চোট পাই ৷ জানি না কীভাব বেঁচে গেলাম ৷ আমার স্ত্রী মিডলে ছিলেন ৷ তাঁরও চোট লেগেছে ৷ উল্টোদিকের বাথে একজন বয়স্ক ব্যক্তি ছিলেন, তাঁর হাঁটুতেও লেগেছে ৷"
দুর্ঘটনার পরের পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, "আমি প্রথমে বার্থ থেকে নেমে, স্ত্রীকে খুঁজতে শুরু করি ৷ তারই মধ্যে লোকজন ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা শুরু করে ৷ আমি দেখি আমার স্ত্রী এক পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওর চোখেমুখে আতঙ্ক ৷ ওকে নিয়ে আগে ট্রেন থেকে নামাই ৷ বাইরে বেরিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, পুরো অন্ধকার ৷ এরপর ফের ট্রেনের ভিতরে যাই আমি ৷ আমাদের ব্যাগ নামিয়ে আনি ৷ আমার ব্যাগে একটা টর্চ ছিল ৷ সেটা আজ এভাবে কাজে লাগবে, ভাবতেও পারিনি ! বাকিদের ট্রেন থেকে নামতে সাহায্য় করি ৷ তার মধ্যে আমাদের বগির অ্যাটেনডেন্টের পা ভেঙে গিয়েছে ৷ রেলের লোকজন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায় ৷"
শ্যামাপ্রসাদ হালদারের বর্ণনায়, "আধঘণ্টা পরে অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ পাই ৷ পুলিশও ততক্ষণে চলে এসেছিল ৷ ভোরের আলো ফুটতে দেখি, সামনে থেকে পিছন পর্যন্ত সব বগি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ৷ আর পাশে, 30-40 ফুট গভীর খাদ ৷ আমাদের ট্রেনের বাঁ-দিকে একটা নতুন লাইন হচ্ছে ৷ সেটা উঁচুতে ৷ সেই লাইনের কংক্রিটের রেলিংয়ে আমাদের ট্রেনের বগিগুলি আটকে যায় ৷ তা না হলে, সোজা 40 ফুট গভীর খাদে গিয়ে পড়তাম ৷ সেটা হলে আর আপনাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারতাম না ৷ প্রাণটাই হয়তো এতক্ষণে চলে যেত !"