নয়াদিল্লি, 22 জুলাই: কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন সোমবার লোকসভায় পরিসংখ্যানগত পরিশিষ্ট-সহ 2023-24 অর্থবর্ষের অর্থনৈতিক সমীক্ষা পেশ করেছেন । অর্থনৈতিক সমীক্ষা হল অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনা করার জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটের আগে সরকারের তরফে লোকসভায় পেশ করা একটি বার্ষিক নথি ।
এই নথি অর্থনীতির স্বল্প থেকে মাঝারি মেয়াদী সম্ভাবনাগুলির একটা ওভারভিউ প্রদান করা হয় । অর্থমন্ত্রকের অধীনে রয়েছে অর্থনীতি বিষয়ক বিভাগ ৷ সেই বিভাগের ইকোনমিক ডিভিশন এই সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করে ৷ কেন্দ্রের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয় ৷
প্রথম অর্থনৈতিক সমীক্ষা 1950-51 সালে পেশ করা হয় ৷ সেই সময় এটা বাজেটের একটি অংশ ছিল । 1960 থেকে এটাকে কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে আলাদা করা হয় ৷ এবং বাজেট উপস্থাপনের একদিন আগে পেশ করা শুরু হয় ৷
এক নজরে আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট
এপ্রিলের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক অনুযায়ী 2023 সালে গ্লোবাল ইকোনমিক গ্রোথ ছিল 3.2 শতাংশ ৷ তবে বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বৃদ্ধির ধরন দেখা দিয়েছে । অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামোগত সমস্যা, ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের জেরে অসম পরিস্থিতি তৈরি হওয়া এবং মুদ্রানীতি কঠোর করার জেরে যে প্রভাব তৈরি হয়, সেই কারণেই বিভিন্ন দেশের বৃদ্ধি বিভিন্নরকম হয়েছে ৷
বাইরের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতি 2023 অর্থবর্ষ থেকে 2024 অর্থবর্ষের প্রবেশের আগেই গতি পেয়েছিল ৷ ভারতের প্রকৃত জিডিপি 2024 অর্থবর্ষে 8.2 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ 2024 অর্থবর্ষের চারটি ত্রৈমাসিকের মধ্যে তিনটিতে 8 শতাংশের বেশি হয়েছে ৷ ম্যাক্রো-ইকোনমিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার উপর বেশি ফোকাস করা হয়েছে ৷ এর ফলে বাইরের চ্যালেঞ্জ ভারতের অর্থনীতিতে ন্যূনতম প্রভাব ফেলেছে ।
2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট (সৌজন্য : 2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট) ক্যাপেক্সের উপর সরকারের জোর ও বেসরকারি বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী গতি পুঁজি তৈরির ক্ষেত্রে বৃদ্ধি এনেছে । 2023-24 সালে গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফরমেশন প্রকৃত অর্থে 9 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । আরও বিস্তারিতভাবে বললে, স্বাস্থ্যকর কর্পোরেট ও ব্যাংক ব্যালেন্স শিট বেসরকারি বিনিয়োগকে আরও শক্তিশালী করবে । আবাসিক রিয়েল এস্টেট বাজারের ইতিবাচক প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পারিবারিক খাতের মূলধন গঠন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে । বিশ্বব্যাপী নানা সমস্যা, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা ও বর্ষার অস্পষ্টতার কারণে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ প্রশাসনিক ও মুদ্রানীতির প্রতিক্রিয়া দ্বারা নিপুণভাবে পরিচালিত হয়েছে । ফলে যে খুচরা মুদ্রাস্ফীতি 2023 অর্থবর্ষে গড় 6.7 শতাংশ ছিল ৷ তা 2024 অর্থবর্ষে 5.4 শতাংশে নেমে এসেছে ।
সম্প্রসারণমূলক সরকারি বিনিয়োগ সত্ত্বেও সরকারের আর্থিক ভারসাম্য ক্রমশ উন্নত হয়েছে । পদ্ধতিগত সংস্কার, ব্যয় সংযম ও ক্রমবর্ধমান ডিজিটাইজেশনের ফলে কর সমস্যা কমেছে ৷ এই লাভের ফলে ভারত এই ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম ভারসাম্য অর্জনে সাফল্য পেয়েছে ৷
2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট (সৌজন্য : 2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট) পণ্যের বিশ্বব্যাপী চাহিদা হ্রাসের কারণে বাহ্যিক ভারসাম্যের উপর চাপ পড়েছে ৷ কিন্তু শক্তিশালী পরিষেবা রফতানি মূলত এটাকে ভারসাম্যহীন করেছে । ফলে 2024 অর্থবর্ষে ক্যাড 0.7 শতাংশ হয়েছে ৷ যা 2023 অর্থবর্ষে 2.0 শতাংশের ঘাটতি থেকে একটু উন্নত হয়েছে ৷ অতিমারী পরবর্তী সময়ে ভারতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও প্রসারিত হয়েছে ।
2024 অর্থবর্ষে প্রকৃত জিডিপি 2020 অর্থবর্ষের একই স্তরের তুলনায় 20 শতাংশ বেশি ছিল ৷ এটা একটা কৃতিত্ব, যা শুধুমাত্র খুব কম বড় অর্থনীতি অর্জন করেছে । ভৌগোলিক, আর্থিক বাজার ও জলবায়ু ঝুঁকির সাপেক্ষে 2025 অর্থবর্ষেও শক্তিশালী বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে ৷
2024 অর্থবর্ষে মুদ্রাস্ফীতিতে রাশ টানা গিয়েছে
2022 ও 2023 অর্থবর্ষে কোভিড-19 অতিমারী, একাধিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সরবরাহে বাধা বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে । আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের কারণে ভারতে ভোগ্যপণ্য ও বিভিন্ন পরিষেবা মূল্যবৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে এবং প্রভাবিত প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে খাবারের খরচও বেড়েছে ৷ কিন্তু 2024 অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের সময়োপযোগী নীতিগত হস্তক্ষেপ ও ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মূল্য স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা খুচরা মুদ্রাস্ফীতিকে 5.4 শতাংশে রাখতে সাহায্য করেছিল, যা অতিমারীর পর সর্বনিম্ন ৷
মূল মুদ্রাস্ফীতি চার বছরে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে
2024 অর্থবর্ষে খুচরা মুদ্রাস্ফীতি কমে যাওয়ায়, তা পণ্য এবং পরিষেবা উভয় ক্ষেত্রেই মূল মুদ্রাস্ফীতি কমতে সাহায্য করে ৷ পরিষেবা ক্ষেত্রে মূল মুদ্রাস্ফীতি 2024 অর্থবর্ষে ন’বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে ৷ একই সময়ে মূল পণ্য মুদ্রাস্ফীতিও চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে । 2024 অর্থবর্ষে পণ্যের দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে শিল্পগুলিতে মূল ইনপুট উপকরণগুলির সরবরাহের উন্নতির কারণে । 2020 ও 2023 অর্থবর্ষের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী মুদ্রাস্ফীতিতে এটা ভালো পরিবর্তন ছিল ৷
প্রতিকূল আবহাওয়ায় খাদ্যের দাম চাপে রয়েছে
গত দু’বছর ধরে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয় । ভারতে আবহাওয়ার খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে কৃষিক্ষেত্র ৷ যার জেরে খাবারের দামে প্রভাব পড়েছে ৷
ফলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি 2023 অর্থবর্ষে 6.6 শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং 2024 অর্থবর্ষে বেড়ে 7.5 শতাংশে পৌঁছেছে । 2024 অর্থবর্ষে প্রতিকূল আবহাওয়া খাদ্যের উৎপাদনকে বাধা দিয়েছিল । ফলে টমেটো, পেঁয়াজের মতো একাধিক ফসলের দাম বেড়েছে ৷ অন্যদিকে রাজ্যগুলিতে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণ গ্রাম ও শহরের মুদ্রাস্ফীতির পার্থক্য ৷ 2024 অর্থবর্ষে বেশিরভাগ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতির হার হ্রাস পেয়েছে ৷ 36টির মধ্যে 29টি রাজ্যে সেই হার 6 শতাংশের নিচে ৷ 2023 এর তুলনায় খুচরা মূল্যস্ফীতির সর্বভারতীয় গড় সামগ্রিক হ্রাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ।
2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট (সৌজন্য : 2023-24 এর অর্থনৈতিক সমীক্ষা রিপোর্ট) খাদ্যমূল্য অধিক হলে গ্রামীণ অংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখা যায় ৷ তাই মুদ্রাস্ফীতির আন্তঃ-রাজ্য বৈচিত্র্য শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বেশি প্রকট হয় ।
ব্যাঙ্কিং ও আর্থিক সেক্টরের পারফরম্যান্স ভারতের ব্যাঙ্কিং এবং আর্থিক ক্ষেত্রগুলি 2024 অর্থবর্ষে শক্তিশালী কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করেছে
ব্যাংক ঋণের বৃদ্ধি ছিল ব্যাপক ও দুই সংখ্যার । গ্রস এবং নেট নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (এনপিএ) বহু বছরের সর্বনিম্নে পৌঁছেছে । উন্নত ব্যাংক সম্পদের গুণমান একটি স্থিতিশীল ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে । মূলধন গঠন প্রাথমিক পুঁজিবাজার 2024 অর্থবর্ষে 10.9 লক্ষ কোটি টাকা পুঁজি গঠনের সুবিধা দিয়েছে । এই পরিমাণ 2023 অর্থবর্ষে বেসরকারি ও সরকারি কর্পোরেটদের দ্বারা মোট স্থায়ী মূলধন গঠনের প্রায় 29 শতাংশ ।
শেয়ার বাজারের কর্মক্ষমতা
ভারতীয় শেয়ার বাজারের বাজার মূলধন উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে । ভারতের বাজার মূলধন ও জিডিপি-র অনুপাত বিশ্বব্যাপী পঞ্চম বৃহত্তম । আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কৌশল: এর মধ্য়ে রয়েছে লক্ষ্য-ভিত্তিক পদ্ধতি, বাজারের উন্নয়ন, পরিকাঠামো শক্তিশালী করা, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, শেষ-পর্যন্ত ডেলিভারি, উপভোক্তার সুরক্ষা এবং আর্থিক সাক্ষরতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে । ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের জন্য অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা এবং রুমে কার্ড ও ইউপিআই-এর মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্টের প্রচারের উপর জোর দেওয়া হয় ।
আগামিকাল, মঙ্গলবার, 23 জুলাই সকাল 11টায় লোকসভায় কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করবেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ৷ বাজেট বক্তৃতায় রাজস্ব নীতি, রাজস্ব ও ব্যয়ের প্রস্তাবনা এবং উল্লেখযোগ্য ঘোষণা থাকবে । বাজেট অনুমোদন ও বাস্তবায়নের আগে সংসদের উভয়কক্ষে (লোকসভা ও রাজ্যসভা) তা বিস্তারিত বিতর্কের মধ্য দিয়ে যাবে । প্রাক-বাজেট আচার-অনুষ্ঠানে বাজেট উপস্থাপনে বেশ কিছু ঐতিহ্যগত পদক্ষেপ জড়িত ।
বাজেটের দিন সকালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নর্থ ব্লকে তাঁর মন্ত্রকের সচিবদের সঙ্গে দেখা করবেন ৷ তারপরে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জন্য অনুমতির জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনে যাবেন । তার আগে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকও হবে ৷ সেখানে মন্ত্রীদের বাজেট নিয়ে জানানো হবে ও মন্ত্রিসভা সেই বাজেটে অনুমোদন দেবে ৷
এই কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বড় নীতি ঘোষণা নিয়ে অধীর আগ্রহ রয়েছে সকলের ৷ এটা ভারতের ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য একটি রোডম্যাপ প্রদান করার সময় বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিকে মোকাবিলা করবে । অর্থনৈতিক সমীক্ষা ও পরবর্তী বাজেট উপস্থাপনা আগামী বছরগুলিতে দেশের আর্থিক গতিপথের মঞ্চ তৈরি করবে ।