বয়স যত বাড়ে, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ ততই একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । এর থেকে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি কিডনির অসুখও হতে পারে । যদিও পৃথিবীজুড়ে অনেকেই হাইপারটেনশন শব্দটার সঙ্গে পরিচিত, কিন্তু তাঁরা এই সমস্যা এবং তা পরিমাপের পদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবহিত নন । তাই এ ব্যাপারে সচেতনতার প্রসার করতে প্রতিবছর 17 মে বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবসের আয়োজন করে ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লিগ (ডব্লিউএইচএল) । 2021-এর থিম হল, ‘নির্ভুলভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, বেশিদিন বাঁচুন ।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীজুড়ে আনুমানিক 1.13 বিলিয়ন মানুষের হাইপারটেনশন আছে । এর দুই-তৃতীয়াংশই রয়েছে নিম্ন ও মধ্যবর্তী আয়ের দেশগুলোতে । 2015 সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি চারজন পুরুষের একজন এবং প্রতি পাঁচজন মহিলার মধ্যে একজনের হাইপারটেনশন ছিল । যেহেতু এই সমস্যার কোনও চিহ্ন বা উপসর্গ দেখা যায় না, তাই মানুষ সাধারণত এর উপস্থিতির কথা বুঝতে পারেন না । এজন্য একে ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ বলা হয়ে থাকে । সুতরাং, নিয়মিত রক্তচাপ মাপা দরকার ।
আরও পড়ুন :ডেঙ্গুর লক্ষণ চিহ্নিতকরণ এবং প্রতিরোধের উপায়
হাইপারটেনশন কী ?
হু ব্যাখ্যা দিয়েছে, ‘রক্তচাপ হচ্ছে সেই বল যা রক্তচলাচলের মাধ্যমে শরীরের ধমনীগুলোর ওপর পড়ে । হাইপারটেনশন হচ্ছে সেই অবস্থা, যখন রক্তচাপ অত্যন্ত বেশি থাকে ।’
রক্তচাপ মাপার বিভিন্ন যন্ত্র আছে, যেখানে দুটো রিডিং দেখা যায় । একটি হল সিস্টোলিক, অর্থাৎ হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হওয়ার সময় রক্তবাহকের ওপর যে চাপ পড়ে এবং অপরটি হল ডায়াস্টোলিক, অর্থাৎ দুবার স্পন্দনের মধ্যবর্তী সময়ে রক্তবাহকের ওপর যে চাপ থাকে ।
এছাড়াও হু বলছে যে হাইপারটেনশন তখনই নির্ধারিত যখন দুবার আলাদা আলাদা দিনে মাপা হয় এবং সিস্টোলিক রক্তচাপ দুক্ষেত্রেই 140 এমএমএইচজি বা তার বেশি এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ 90 এমএমএইচজি বা তার বেশি থাকে । পরীক্ষা করানোর পর আপনি ওষুধ বা চিকিৎসা সম্পর্কে জানতে আপনার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন ।
উচ্চ রক্তচাপ কীভাবে সামলাবেন ?
হায়দরাবাদের ভিআইএনএন হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ রাজেশ ভুক্কালা কয়েকটি পথ বলে দিলেন, যার সাহায্যে উচ্চ রক্তচাপ মোকাবিলা করা যায় ।
- রুটিন :সঠিক রুটিন মেনে চলুন । সময়ে ঘুম থেকে উঠুন এবং ঘুমোতে যান । নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়াদাওয়া করুন । শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা বজায় রাখুন ।
- ক্যাফিন নয় : দৈনন্দিন ক্যাফিনের পরিমাণ কমান । যতটা পারেন এড়িয়ে চলুন । ক্যাফিন রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে । যদিও এটা একজন থেকে অন্যজনের ক্ষেত্রে আলাদাও হতে পারে ।
- জাঙ্ক নয় :জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে থাকুন, কারণ এতে চিনি, ক্যালোরি ও পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেট ঠাসা থাকে, যার সঙ্গে রক্তচাপের যোগসূত্র রয়েছে । বাড়িতে তৈরি স্বাস্থ্যকর খাবারই খাওয়া উচিত ।
- শরীরচর্চা : ধ্যান, যোগাসন ও হাঁটার মতো এক্সারসাইজের পরামর্শ দেন ডাঃ রাজেশ । তিনি বলেন, ধ্যান আপনার মনকে শান্ত করে এবং স্ট্রেস কমায় । এছাড়াও রক্তচাপ দূর করে হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে ব্যায়ামই হল সবথেকে ভাল উপায় ।
- সঠিক ওজন : আপনার বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) বজায় রাখুন । এটা 23 থাকা উচিত (প্লাস-মাইনাস 1) । ওজন বেশি হলে হৃদযন্ত্রে প্রভাব ফেলতে পারে । সুতরাং সঠিক ওজন বজায় রাখুন ।
- সোডিয়াম কমান : খাবারে সোডিয়ামের পরিমাণ কমান । অতিরিক্ত নুন আপনার রক্তচাপে প্রভাব ফেলতে পারে ।
- ধূমপান/মদ্যপান নয় :মদ্যপান কমান বা সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন । ধূমপানও ছেড়ে দিন ।
ডাঃ ভুক্কালা বলেন, “গত তিনদশকে মানুষের মধ্যে চিন্তার মাত্রা বেড়েছে । রক্তচাপ হল এমন একটা সমস্যা যা আপনি সাধারণত 50 বছরের ওপরের কোনও মানুষের মধ্যে খোঁজেন । কিন্তু এখন আরও বেশি তরুণ-তরুণীরা এতে ভুগছে, যার প্রধান কারণ হল চিন্তা । তাই জানতে হবে যে কীভাবে চিন্তাকে ম্যানেজ করা যায়, যাতে স্বাস্থ্যের ওপর তার কুপ্রভাব না পড়ে ।”
রক্তচাপ মাপার সময় টিপস
- রক্তচাপ যখন মাপা চলছে, তখন কথা বলবেন না ।
- আপনার হাত কোনও কুশন বা বালিশের ওপর অথবা চেয়ারের হাতলে এমনভাবে রাখুন, যাতে তা হৃদযন্ত্রের সমান্তরালে থাকে ।
- জামার ওপর নয়, হাতের খালি অংশে কাফটি পরুন । সঠিক আকারের কাফ ব্যবহার করুন ।
- চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে পা মাটিতে রাখুন ।
- পা আড়াআড়িভাবে রাখবেন না ।
- রক্তচাপ মাপার আগে ব্লাডার খালি রাখুন ।
- কোনও কাজকর্ম করার পর সঙ্গে সঙ্গে প্রেসার মাপবেন না । 10 মিনিট বিশ্রাম করার পর তারপর মাপুন ।
কোভিড-19 ও হাইপারটেনশন
যদি অস্বস্তি থাকে এবং বিপি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন । যাঁদের হাইপারটেনশন রয়েছে, তাঁদের এই কোভিড পরিস্থিতিতে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার । যেহেতু হাইপারটেনশনকে কোমর্বিডিটি হিসেবে ধরা হয়, সেজন্য এই সমস্যায় থাকা ব্যক্তিদের কোভিডে গুরুতর সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি । ডব্লিউএইচএল নিম্নলিখিত বিষয়গুলো মাথায় রাখার পরামর্শ দিচ্ছে :
- প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রেসারের ওষুধ খেতে থাকুন ।
- সম্ভব হলে বাড়িতেই আপনার রক্তচাপ মাপুন । এতে কিছু কমবেশি হতে পারে, কিন্তু সম্ভব হলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা না বলে চিকিৎসা শুরু করবেন না। মনে রাখবেন, ঠিকমত হাইড্রেশনের অভাব হলেও রক্তচাপ কমতে পারে ।
- হাইড্রেটেড থাকুন । অনেক মানুষ, এমনকি বড়রাও অনেক সময় সঠিক পরিমাণে তরল পান করেন না । সারাদিন ধরে যাতে নিয়মিত জল খাওয়া হয়, সেদিকে নজর রাখুন ।
- যেহেতু ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে আমরা অনেকেই এখন ঘরের মধ্যে বেশি সময় কাটাচ্ছি, তাই আমাদের শারীরিক পরিশ্রমও কমে যাচ্ছে । এর সমাধান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাড়ির বাইরে হেঁটে আসা । কঠিন সময়ে চাঙ্গা এবং সুস্থ থাকতে এটা একটা ভাল অভ্যাস ।
আরও পড়ুন :করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও দুর্বল লাগছে ? জেনে নিন দুর্বলতা কাটানোর উপায়