গাইঘাটা, 4 অগস্ট: পনেরো বছরের নবম শ্রেণির ছাত্রী ৷ দুই চোখে তার পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ৷ উত্তর 24 পরগনার গাইঘাটা থানার চাঁদপাড়া ঢাকুরিয়া বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সে ৷ কিন্তু, ছাত্রীর বাড়িতে তার অসুস্থ বাবা রয়েছেন ৷ দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার ৷ তাই পড়াশোনার মাঝেই পরিবারের হাল ধরেছে সে ৷ বাবার টোটো চালিয়ে সংসার ও নিজের পড়াশোনা চালাচ্ছে কিশোরী ৷ সঙ্গে তাঁর মা পরিচারিকার কাজ করেন ৷ তবে, এই টোটো চালানো নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন এবং বলছেনও ৷ তবুও, পরিবার এবং নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে সমালোচনার স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে চলেছে রূপা ৷
বছর 55’র প্রৌঢ় রূপার বাবা ৷ বছর খানেক আগে তিনি সেলিব্রাল অ্যাটাকের কারণে শয্যাশায়ী ৷ এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে দুই মেয়ে এবং স্ত্রী ৷ দুই মেয়ের পড়াশোনা, নিজের চিকিৎসা এবং সংসার খরচ ৷ কোনও কিছুই চালাতে পারেননি ৷ স্ত্রী পরিচারিকার কাজ করেন ৷ এমনই দৈন অবস্থা তাঁদের ৷ এই পরিস্থিতিতে পরিবারের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন 15 বছরের মেয়েটি ৷ বাস্তব জীবনে সে সত্যিই যেন দশভূজা ৷
খেলার ছলে বাবার টোটো চালানো শিখেছিল ৷ সেটাই বর্তমানে সংসারের হাল ফেরাতে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে সে ৷ পড়াশোনার পাশাপাশি, সে টোটো চালিয়ে সংসারের ভার বইছে, বাবার চিকিৎসার খরচ জোগাচ্ছে ৷ দিনের বেলা স্কুলে যাওয়া এবং স্কুল থেকে ফিরে রাত পর্যন্ত টোটো চালানো ৷ মাঝে সময় বের করে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ৷ এখন পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে টোটো চালাচ্ছে রূপা ৷ তবে, তার স্বপ্ন বিমানের ককপিটে বসে তার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেওয়া ৷ বড় হয়ে পাইলট হতে চায় সে ৷
পাইলট হওয়ার এখনও অনেক দূর ৷ কিন্তু, বর্তমান পরিস্থিতিতে টোটো চালিয়ে সংসার ও পড়াশোনা করা কিশোরীকে নিয়ে চলে নানা কথা । 18 বছর না হওয়ায় বড় রাস্তায় টোটো চালানোর ছাড় নেই তার ৷ এই পরিস্থিতিতে একটি মেয়ে গ্রামের রাস্তা টোটো চালাতে গেলে, অন্যান্যরা আপত্তি করে ৷ যদিও, অনেক লড়াই করে সেই বাধা পেরিয়েছে সে ৷ কিন্তু, বাবা ও মা-কে মাঝে মধ্যেই আশেপাশের লোকজনের কথা শুনতে হয় ৷ তবে, সে সব কথা গায়ে মাখে না এই দস্যি মেয়ে ৷
তার বাবা বলেন, "হতভাগা বাবা আমি ৷ মেয়ের শখ আহ্লাদ পুরোন করার কথা আমার ৷ কিন্তু, মেয়ে আমার চিকিৎসার টাকার জন্য টোটো চালাচ্ছে ৷ দিন রাত খেটে চলেছে ৷ ছোট মেয়ের টোটো চালানো মেনে নিতে পারছি না ৷ কিন্তু, আমিও কিছু করতে পারছি না ৷" তার মায়ের কথায়, "মেয়ে হয়ে টোটো চালাচ্ছে ৷ মানুষ নানা কথা বলছে ৷ পরিবারের কথা ভেবে সব শুনতে হচ্ছে ৷" মেয়ের কাজ করা হয় তো মেনে নিতে পারছেন না ৷ এই বয়সে তাঁর কাজ করার কথাও নয় ৷ তবুও, পরিবারের জন্য সব করতে প্রস্তুত রূপা ৷
তার কথায়, "স্কুলে যাওয়া সময় এক জন দিদিমণিকে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে তার পর নিজে স্কুলে যাই ৷ স্কুল ছুটির পর সেই দিদিমণিকে আবার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি ৷ সেখানে বাড়তি কিছু আয় হয় ৷ প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজের পড়া করি ৷ সাতটা নাগাদ টোটো নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি ৷ সেখান থেকে বাড়ি ফিরে স্কুলে যাই ৷ সব দিন সকালে বাড়িতে খাওয়ার সময় হয় না ৷ স্কুলের মিড ডে মিল দেয়, তাতে হয়ে যায় ৷"
নিজের লড়াইয়ে পাশে পেয়েছে স্কুলের শিক্ষিকাদের ৷ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রত্না রায় বলেন, "আমরা জানি সমাজে শিশুশ্রম গুরুতর অপরাধ ৷ কিন্তু, আমরা কিছু করতে পারছি না ৷ কারণ, ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর সংসার চালাতে ওকে কাজ করতে হচ্ছে ৷ আমরা সব সময় ওর পাশে আছি ৷ ওকে সব সময় বলি, ও যেন পড়াশোনা বন্ধ না করে ৷ কোন অসুবিধা হলে আমাদের জানায় ৷" কিশোরীও নিজের স্বপ্নের লক্ষ্যে ছুটে চলেছে ৷ ইটিভি ভারতের শুভেচ্ছা রইল, তার এই স্বপ্নের দৌড় যেন সফল হয় ৷