মহিষাদল, 15 অগাস্ট : সালটা 1942 । ডিসেম্বরের 17 তারিখ পরাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় সরকার । তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । সর্বাধিনায়ক বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত । সেই তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম যোদ্ধা ছিলেন মহিষাদলের স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন সামন্ত । ঘুমের মধ্যে আজও কানে বাজে গুলিবিদ্ধ সতীর্থদের আর্তনাদ । 73 তম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ETV ভারতকে জানালেন কী হয়েছিল 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর ।
মহিষাদলের কালিকাকুণ্ডু গ্রামে ছিল চিত্তরঞ্জনবাবুর বাড়ি । তখন নবম শ্রেণিতে পড়েন । গান্ধিজীর ডাকে সাড়া দিয়ে অগাস্ট আন্দোলনের শরিক হন । বাবা হরিরাম সামন্ত । পেশায় শিক্ষক ও কংগ্রেস কর্মী । বাবার সহকর্মী সুশীলকুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সামন্ত । তাঁদের সঙ্গে প্রায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেন । এখন বয়স 96 । শরীরে সেই জোর নেই । কিন্তু চোখে আজও সেই তেজ । মনে সাহস ।
একদিকে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । অন্যদিকে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী দেশের পূর্ব প্রান্তে পৌঁছে গেছে । গান্ধিজিও ইংরেজ 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন । এই সময় আন্দোলনের গতি রুখতে ব্রিটিশ সরকার ঘর পোড়া নীতি নেয় । ভয়, নেতাজি যদি পৌঁছে যায় তাহলেই বিপদ । তাই আগেভাগেই তারা সাইকেল, গোরুর গাড়ি, নৌকা সব তুলে নিতে শুরু করে । খাদ্যশস্য, সবজি সিজ় করে । সে সময় ব্রিটিশ বাহিনীকে রুখতে থানা দখলের নির্দেশ আসে । নির্দেশ দেন স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র সামন্ত । ঠিক হয় 29 সেপ্টেম্বর মহিষাদল থানা দখল করা হবে । তমলুকের ছ'টি থানার মধ্যে মহিষাদল থানা দখলের দায়িত্বে ছিলেন চিত্তরঞ্জনবাবু । তাঁর দাদা ছিলেন সুতাহাটা থানা দখলের দায়িত্বে । আগের দিন রাতেই পুলিশ বা মিলিটারি যাতে গ্রামে ঢুকতে না পারে, বড় বড় গাছ কেটে ফেলে রাখা হয় রাস্তায় । 29 তারিখের মিছিলে চিত্তরঞ্জনবাবুর সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন ধনী- দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় 40 থেকে 50 হাজার মানুষ । মিছিল মহিষাদল রাজবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছায়, সে সময় হঠাৎ করে গুলি চালানো শুরু করে পুলিশ । ভোলানাথ মাইতির বুকে প্রথম গুলি লাগে । তাঁকে কোনওরকমে তুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । তবুও দমে না গিয়ে মিছিলকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান চিত্তরঞ্জনবাবু । এরপর একে একে গুলিবিদ্ধ হন হরিচরণ দাস, বটু মাইতিরা । পুলিশের গুলি থেকে নিজেদের বাঁচাতে ঢাল হিসেবে টিনের কপাট সামনে রেখে এগিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা । কপাট ভেদ করে গুলি লাগে সাধারণ মানুষের গায়ে । ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল । সে দিনের সেই থানা দখল অভিযানে মৃত্যু হয় 13 জনের । আহত হয়েছিলেন প্রায় 70 হাজার মানুষ । সে দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে চিত্তরঞ্জনবাবুর আক্ষেপ, "আমার সঙ্গে থানা দখল অভিযানে গিয়ে ভোলানাথ মাইতি ও হরিচরণ দাস গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন । ওনারা দু'জনেই হতদরিদ্র ছিলেন । সে দিন আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমি কেন মরলাম না ? ওনাদের বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেব ? শুধুমাত্র ভোলানাথের মৃতদেহ পেয়েছিলাম । বাকি অনেকের মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে গেছিল । "