নন্দীগ্রাম, 5 জুলাই:পঞ্চায়েত নির্বাচনের বাকি আর মাত্র দু'দিন ৷ ভাঙড়, দিনহাটা, চন্দ্রকোনা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে হানাহানির ঘটনায় স্পষ্ট যে, জোর টক্কর হতে চলেছে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে ৷ তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে রাজ্যের যুযুধান দুই রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির কাছে এ বার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ নিঃসন্দেহে নন্দীগ্রাম ৷
বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করলেও জমি আন্দোলনের অন্যতম ধাত্রীভূমি হিসেবে পরিচিত এই নন্দীগ্রাম থেকে হারের মুখ দেখতে হয়েছিল শাসকদলকে ৷ একসময়ের অনুগামী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে মাত্র কিছু ভোটে হার শিকার করতে হয়েছিল স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়কে ৷ যে কারণে আজও তাঁকে কেয়ারটেকার মুখ্যমন্ত্রী বলে কটাক্ষ শুনতে হয় বিরোধী দলনেতার মুখে ৷ আবার উলটো দিকে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে জয়ের অভিযোগ শানায় তৃণমূল ৷ কাজেই এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচন যেন জবাব দেওয়ার মঞ্চ দু'পক্ষের কাছেই ৷
নন্দীগ্রাম প্রথম রাজ্য রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিল 2007 সালে, যখন তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ আর সবশেষে নন্দীগ্রাম রাজ্যের রাজনীতিতে অন্যতম চর্চার বিষয় হয়েছে 2021 সালে ৷ যখন তাঁর পূর্বের অভিভাবক হিসেবে পরিচিত সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ভোটের ময়দানে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ তবে আসন্ন ভোটে প্রাক্তন স্থানীয় তৃণমূল নেতা থেকে নির্দল প্রার্থী হওয়া ব্যক্তিরা গেরুয়া শিবিরের পালে হাওয়া লাগাতে পারে বলে আশা করছে বিজেপি ৷
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাপতি শেখ সুফিয়ান পিটিআই-কে বলেছেন, "আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হল, নন্দীগ্রামে হারানো মাঠ পুনরুদ্ধার করা ৷ কারণ এটি আমাদের জন্য যে কোনও একটা জায়গা নয়, বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শে বিশ্বাসী সকলের জন্য একটি রাজনৈতিক তীর্থযাত্রা । বিজেপি অনৈতিক ব্যবহার করে এই বিধানসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিল । কিন্তু নন্দীগ্রাম এ বার বিজেপিকে শিক্ষা দেবে ৷"
জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের এই প্রবীণ নেতাকে এ বার টিকিট দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস ৷ তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, বেশ কয়েকজন প্রার্থী, যাঁরা এ বার টিকিট পাননি, তাঁরা নির্দল হিসাবে লড়ছেন ৷ তাঁরা কিছু এলাকায় সমস্যা তৈরি করতে পারেন বলে মনে করছে শেখ সুফিয়ান ৷ তবে সেই বিদ্রোহীরা কখনওই নির্বাচনের নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারবেন না বলে তিনি মনে করছেন ৷
আরও পড়ুন:নির্বাচনী আবহে হাঁটুতে অস্ত্রোপচার মুখ্যমন্ত্রীর, কড়া নিরাপত্তা এসএসকেএমে
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ, যার অধীনে নন্দীগ্রাম পড়ে, সেটি 2008 সাল থেকে তৃণমূলের দখলে ৷ সংখ্যালঘু জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই জেলাকে ওই বছর বামেদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল ঘাস-ফুল শিবির ৷ এরপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ।
2013 এবং 2018 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এখানে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করে তৃণমূল ৷ 2018 সালের ভোটে তারা জয়ী হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় । তবে 2021 সালে প্রাক্তন দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে পাড়ি জমানো এখনও শাসক দলের কাছে একটা বড় ক্ষতি ।
নন্দীগ্রামের দুটি ব্লকে -- ব্লক 1 এবং 2 -- যেখানে যথাক্রমে প্রায় 40 এবং 17 শতাংশ সংখ্যালঘু জনসংখ্যা রয়েছে, সেখানে তৃণমূল 80 শতাংশ আসনে নতুন মুখ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৷ যার ফলে প্রবীণদের অনেকেই টিকিট না পেয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে নির্দল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ফাটল ধরিয়েছে দলীয় পদে ৷ এই বিদ্রোহ ভোট ভাগ করতে তাদের সাহায্য করবে বলে আশাবাদী বিজেপি ।
বিদ্রোহী নেত্রী নাসিমা খাতুন, যিনি জেলা পরিষদ সদস্য হয়েও টিকিট না পেয়ে এ বার নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তিনি অভিযোগ করেন, "দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হল নন্দীগ্রামে হারানো মাঠ পুনরুদ্ধার করা ৷ কিন্তু এটিতে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে নেতৃত্ব পুরনোদের এড়িয়ে গিয়েছে এবং নতুনদের প্রতি আস্থা দেখিয়েছে, যাঁরা বেশিরভাগই এসেছেন বিজেপির থেকে ৷"
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রাম পরিষদে দলের নেতা-কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও কর্মে অদক্ষতার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মুখদের তুলে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাসকদল ৷ নির্দল প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আর এক তৃণমূল নেতা বলেন, "দল কি মনে করে যে তারা যে প্রার্থী দিয়েছে তাঁরা সবাই সাধু এবং আমরা সবাই চোর ? যাঁদের টিকিট দেওয়া হয়েছে তাঁদের বেশিরভাগই বিজেপির দুর্নীতিবাজ এজেন্ট । দল তার পরীক্ষিত কর্মীদের উপেক্ষা করার জন্য মূল্য চোকাবে ৷"
আরও পড়ুন:ইডির ডাক এড়িয়ে গলসিতে প্রচারে সায়নী, নির্বাচনের পর হাজিরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি
যদিও দলের বিদ্রোহীদের খুব বেশি গুরুত্ব দিতে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস ৷ নন্দীগ্রাম ব্লক সভাপতি এবং যুব নেতা বাপ্পাদিত্য গর্গ বলেছেন, "গত 15 বছরে যে উন্নয়নমূলক কাজ করেছে তার কারণেই তৃণমূল জিতবে । মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ভোট দেয় । 2021 সালে বিজেপি প্রতারণা এবং ঘৃণার রাজনীতির মাধ্যমে আমাদের পরাজিত করেছিল । এ বার আমাদের জয় হবে বিজেপিকে আমাদের দেওয়া জবাব ৷"
এ দিকে, বিজেপির পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সদস্য অভিজিৎ মাইতি বলেছেন যে, তারা এই অঞ্চলে 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পুনর্নির্মাণের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ৷ সে বার মাত্র 1,900 ভোটের ক্ষীণ ব্যবধানে এই আসন জিতেছিল বিজেপি । তাঁর কথায়, "এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনে টিএমসি পরাজিত হবে । নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার করার জন্য আমরা তাদের চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত । গত 15 বছরের দুর্নীতির জন্য তাদের জবাব দিতে হবে ৷"
2016 সাল থেকে বিজেপি এখানে তার ভাগ্যের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সাক্ষী হয়েছে ৷ 2016 সালের উপনির্বাচনে তমলুক লোকসভা আসনের 1.96 লক্ষের বেশি ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি । 2019 সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীরা 5.34 লক্ষেরও বেশি ভোট পান ৷ 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনেও নন্দীগ্রাম-সহ জেলায় যথেষ্ট ভালো ফল করে গেরুয়া শিবির ৷ তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই ধারা তারা বজায় রাখতে পারে কি না, সে দিকেই তাকিয়ে রাজনৈতিক মহল ৷