125 দিন পর দ্বিতীয় শিশুর জন্ম বর্ধমান মেডিক্যালে বর্ধমান, 17 নভেম্বর:প্রসূতির গর্ভে এসেছিল যমজ সন্তানের ভ্রূণ । মাস চারেক আগে অপরিণত অবস্থায় জরায়ুর মধ্যেই একটি ভ্রূণের মৃত্যু হয় । ফলে সেই মৃত ভ্রূণ প্রসবের পরে আমবিলিক্যাল কর্ড বেঁধে জরায়ুতে ফিরিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ করাটা চ্যালেঞ্জ ছিল চিকিৎসকদের কাছে । যে কোনও মুহূর্তে মা ও সন্তানের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল । তবে তা হয়নি চিকিৎসকদের তৎপরতায় ৷ 125 দিন ধরে ওই প্রসূতিকে নিজেদের হেফাজতে রেখে সুস্থ ভাবে দ্বিতীয় শিশুকে ভূমিষ্ঠ করালেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ।
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তথা ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. তাপস ঘোষ বলেন, "এটা একটা বিরলতম ঘটনা । 1996 সালে বাল্টিমোরে এইভাবে একটি শিশুকে 90 দিন গর্ভে রাখা হয়েছিল । কিন্তু 125 দিন গর্ভে রাখার রেকর্ড কোথাও নেই ।"
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর 41-এর এক প্রসূতি গত জুলাই মাসে হাসপাতালে আসেন । চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, তার গর্ভে যমজ সন্তান আছে । এর মধ্যে একটা শিশু জরায়ুর মধ্যেই মারা যায় । চিকিৎসকেরা সেই মৃত ভ্রূণের প্রসব করিয়ে আমবিলিক্যাল কর্ড বেঁধে জরায়ুতে ফিরিয়ে দেন । ফলে দ্বিতীয় শিশুটিকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ঠ করতে গিয়ে সংক্রমণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল ৷ আর সেটাই ছিল চিকিৎসকদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের । সেই কারণে ঝুঁকি এড়াতে ওই প্রসূতিকে ছুটি না দিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল টিম গঠন করে হাসপাতালেই তাঁকে রেখে দেওয়া হয় ।
তাঁকে 125 দিন ধরে হাসপাতালে নিজেদের পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা চলতে থাকে । এরপর গত 14 নভেম্বর শিশু দিবসের দিনে সিজার করে দ্বিতীয় শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ করানো হয় । শিশুটির ওজন হয়েছে 2 কেজি 900 গ্রাম । শিশু ও তার মা দুজনেই সুস্থ আছে ।
চিকিৎসক ডা. মলয় সরকার বলেন, "যেহেতু মায়ের বয়স 41, সেইসঙ্গে আইভিএফ করা হয়েছে, তাই খুব জটিলতা ছিল । এ ক্ষেত্রে মায়ের সঙ্গে শিশুর জীবনেও সংশয় ছিল । এটাকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই । আমরা তাঁকে 125 দিন ধরে ভরতি রেখে চিকিৎসা করি । অবশেষে সাফল্য পাই ।"
শিশুর বাবা অনুপ প্রামাণিক বলেন, "মেডিক্যাল কলেজে ভরতি করেছিলাম । আজ চিকিৎসকদের জন্যই আমার জীবনে ভালো দিন এসেছে । প্রথম বাচ্চা চার মাসের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায় । বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একদম ভেঙে পড়ি । খুব চিন্তায় পড়ে যাই । তখন স্ত্রীকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভরতি করি । চিকিৎসকেরা সহানুভূতির সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন । মাস পাঁচেক ধরে তাঁরা এখানে রেখে দিয়ে আমার স্ত্রীকে চিকিৎসা করতে থাকেন । হয়তো বাড়িতে থাকলে ফের বিপদ ঘটতে পারত । চিকিৎসকেরা আমার কাছে ভগবান ।"
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সুপার তথা ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. তাপস ঘোষ বলেন, "হাসপাতালের গাইনি বিভাগে একটা ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম, যেখানে টুইন প্রেগনেন্সি ছিল ৷ প্রথম বাচ্চাটি জরায়ুর ভিতরেই মারা যায় ৷ এরপরেও দ্বিতীয় বাচ্চাটি যাতে প্রিম্যাচিয়োর না হয়, সে জন্য তাকে জরায়ুতে রেখে দিয়ে চিকিৎসা চলতে থাকে । এরপর তাকে ভূমিষ্ঠ করতে পেরেছি । বছর 41-এর মহিলা আইভিএফ করেন । তাঁর প্রথমবার আইভিএফ ফেল করে । দ্বিতীয়বার আইভিএফ করা হলে টুইন প্রেগন্যান্সি হয় । পেটের মধ্যেই একটা বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জুলাই মাসে ডেলিভারি করা হয় । অপরিণত বাচ্চার ওজন ছিল 125 গ্রাম । আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল দ্বিতীয় যে শিশুটি আছে তাকে বাঁচানো । সেক্ষেত্রে আমাদের সার্জিক্যাল টিম গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখভাল শুরু করেন । প্রথম ডেলিভারির পরে আমবিলিক্যাল কর্ডকে বেঁধে ফের সেটা জরায়ুতে ফিরিয়ে দেন । যাতে দ্বিতীয় শিশুটি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে । সে ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, যাতে দ্বিতীয় বাচ্চাটার ইনফেকশন না হয়ে যায় ।"
তিনি আরও বলেন, "বাচ্চার মাকে যদি ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বাড়ি ফিরে গিয়ে কাজকর্ম করতে গিয়ে দ্বিতীয় বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল । তাই আমরা ঠিক করি যে, আলাদাভাবে এই রোগীকে আমরা রেখে দেব যতদিন না দ্বিতীয় বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হচ্ছে । বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে সেই জন্য একটা আলাদা টিম তৈরি করা হয় । ওই টিম শিশু ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত পুরো বিষয়টি দেখভাল করে । এইভাবে 125 দিন ধরে দেখভাল করা হয় । গত 14 নভেম্বর শিশু দিবসের দিনে সিজারিয়ান সিস্টেমের মাধ্যমে দ্বিতীয় বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হয় । এটা একটা বিরলতম ঘটনা । 1996 সালে বাল্টিমোরে এইভাবে একটা শিশুকে 90 দিন গর্ভে রাখা হয়েছিল । কিন্তু 125 দিন গর্ভে রাখার রেকর্ড কোথাও নেই ।" বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকদের এটা একটা বিরাট সাফল্য ।
আরও পড়ুন:
- মাতৃগর্ভেই ভ্রূণের অস্ত্রোপচার করে নজির গড়ল দিল্লির এইমস
- দু ভাগে বিভক্ত জরায়ুতে যমজ সন্তান, বিরল অস্ত্রোপচার করে ইতিহাস গড়ল শান্তিপুরের হাসপাতাল