কেশপুর, 22 ফেব্রুয়ারি : 2011 পর তৃণমূল জমানায় কেমন রয়েছে কেশপুর ? লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত কেশপুরে সন্ত্রাস এখনও বিরাজমান নাকি শান্তি বিরাজ করছে ? সরেজমিনে খতিয়ে দেখলেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ।
কেশপুর । যার নাম শুনলে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে । পশ্চিম মেদিনীপুরের সন্ত্রাস কবলিত লালদুর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল কেশপুর । তবে ধীরে ধীরে কেশপুর ছন্দে ফিরেছে । বলা যায়, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার 15টি বিধানসভার মধ্যে অন্যতম 235-এর কেশপুর । এখানে বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম । তাঁদের প্রধান জীবিকা চাষবাস । পাশাপাশি ছোটো-বড় হাতের কাজ ও ব্যবসার সঙ্গে অনেকে যুক্ত । তবে আজ থেকে প্রায় 20 বছর আগে কেশপুরের চেহারা ছিল অন্যরকম । তখন বিরোধী আসনে থাকা তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করত, কেশপুরের মানুষজনের স্বাধীনতা নেই । নেই চাষ করার অধিকার । প্রায়ই গুলিগোলা চলত । রাজনৈতিক সংঘর্ষও লেগে থাকত । এই কেশপুরের নাম শুনলে শিউরে উঠতেন মানুষজন । এলাকায় বামেদের দাপাদাপি ছিল প্রবল । সাধারণ মানুষের পাশাপাশি পুলিশের কাজ করার অধিকার চলে গিয়েছিল বলে বিরোধী দলগুলি তখন অভিযোগ করত । কেশপুরের বাতাসে যেন মিশেছিল বারুদের গন্ধ ।
রাজনৈতিক সংঘর্ষের সঙ্গে বাক স্বাধীনতা ছিল না বললে চলে । জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া, আগুন ধরিয়ে দেওয়া ছিল রোজকার ঘটনা । বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, শাসক বিরুদ্ধ কথা বললে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন আকছার দেখা যেত । পাল্লা দিয়ে চলত পুলিশের হয়রানি । এরপর 2011-র বিধানসভা নির্বাচনে কেশপুরে বামেদের হঠিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল কংগ্রেস । স্থানীয় মানুষজনের দাবি, এরপরে কেশপুরের কিছুটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে তৃণমূল সরকার । বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা প্রদান করার চেষ্টা হয়েছে । রাজনৈতিক সংঘর্ষ এড়িয়ে পুলিশের হাতে কঠোরভাবে সন্ত্রাস দমনে অধিকার দেওয়া হয়েছে । এত কিছুর পরে কেশপুরে অবশ্য রাজনৈতিক সংঘর্ষ থামেনি । আগের মতো প্রতিদিন সংঘর্ষ না ঘটলেও মাঝেমধ্যে বোমা-গুলির আওয়াজ পাওয়া যায় ।
10 বছর পর লালদুর্গ কেশপুর কেমন আছে ? আরও পড়ুন :কেশপুরের রাস্তায় রুটমার্চ কেন্দ্রীয় বাহিনীর
বছর দশেক পর আবার দোরগোড়ায় ভোট । এবার অবশ্য সন্ত্রাস দমনে কঠোর হাতে ব্যবস্থা নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন । ভোটের আগে থেকে এলাকায় রুটমার্চ করছে কেন্দ্রীয় বাহিনী । পুলিশকে কঠোরভাবে সন্ত্রাস দমনে ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানানো হয়েছে । তবে কেশপুর আছে কেশপুরে । এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিগত বাম সরকার আমলে যে ধরনের সন্ত্রাস হত । চাষবাস বন্ধ করে দেওয়া, জল না দেওয়া, গুলি-গোলা, আহত, রাজনৈতিক সংঘর্ষ সেসব অনেক কমে এসেছে । কিন্তু এখনও নিচুস্তরের তৃণমূল নেতাদের দাপাদাপির রয়ে গেছে । এলাকাবাসী বলছেন, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন মানুষ সরকারি প্রকল্পের আওতায় আসুন । সেখানে নিচুস্তরের তৃণমূল নেতাদের চোখ রাঙানিতে এলাকার মানুষ সন্ত্রস্ত ।
যদিও গত লোকসভা নির্বাচনে বামেদের সরিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছে বিজেপি । আর তাতে ফের নতুন করে সংঘাতের আবহ কেশপুরে । তবে এ বিষয়ে কেশপুরে তৃণমূলের মুখপাত্র তথা সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ রফিক বলেন, "98-এর আগে থেকে কংগ্রেস করে আসছি আমরা । পরবর্তীকালে তৃণমূলে যোগ দিয়েছি । আমরা বাম জমানায় যে সন্ত্রাস দেখেছি তা কোনওদিন ভোলার নয় । ভোটের অধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের । কেশপুরে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল । পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল । আমরা তার পরিবর্তন করেছি । এখন মানুষ শান্তিতে রয়েছেন । বিজেপি নতুন করে অশান্তির চেষ্টা করছে । এবারেও আমরা বিপুল ভোটে জিতে এলাকায় শান্তি স্থাপন করব ।"
পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএম জেলা সম্পাদক তরুণ রায় বলেন, "কেশপুর রয়েছে কেশপুরে । গত 2011-র আগে ওখানে শান্তি বিরাজ করত । মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারত । কিন্তু 2011-র পর থেকে সমস্যা সৃষ্টি করেছে তৃণমূল । এরপর আমাদের বহু কর্মী ঘরছাড়া ছিল । যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হয়, মানুষ যদি নিজের ভোট নিজে দিতে পারে, তাহলে পুনরায় সিপিআইএম ক্ষমতায় ফিরবে ।" অপরদিকে বিজেপির বক্তব্য একটু অন্যরকম । এলাকায় শান্তি রয়েছে বলে দাবি করেন বিজেপির ঘাটালের সাংগঠনিক নেতা তন্ময় ঘোষ । তিনি বলেন, "2011-র আগে তৃণমূলের লোকেরা সিপিআইএমকে দিয়ে গণ্ডগোল করত । পরবর্তীকালে তারা ক্ষমতায় আসার পর নিজেরাই অশান্তি করে চাষবাস বন্ধ করে দেয় । গত লোকসভা নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী ভারতী ঘোষকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে । কিন্তু আমরা তার জবাব দিতে শুরু করায় এলাকায় শান্তি এসেছে ।"
আরও পড়ুন :উত্তপ্ত কেশপুর, ভারতীর বিরুদ্ধে জোড়া FIR, বিক্ষিপ্ত অশান্তিতে কাটল ভোট
বামেদের সরিয়ে বিজেপি এখন রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল । তবে আগামী দিনে বিজেপি ক্ষমতায় এলে কেশপুরে শান্তি থাকবে না অশান্তি, তা সময় বলবে । তবে ভোট শান্তিপূর্ণ হোক, চাইছেন কেশপুরবাসী ।