ওটিটির যুগে দিন পরিবর্তনের আশায় বুক বাঁধছে থিয়েটারের কলাকুশলীরা মেদিনীপুর, 28 অগস্ট:একসময় গ্রামগঞ্জে দাপিয়ে বেড়িয়েছে থিয়েটার ৷ গ্রামে থিয়েটার হবে শুনলেই ভিড় জমাতো আশপাশের শয়ে শয়ে মানুষ ৷ তবে এখন ওটিটির যুগ ৷ সিনেমা থেকে সিরিয়াল, এক ক্লিকেই চোখের সামনে হাজির সব ৷ ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে থিয়েটারে ৷ আগের মতো আর রমরমা চাহিদা নেই ৷ খুব বেশি দর্শকও আর থিয়েটার দেখতে আগ্রহী হচ্ছে না ৷ তবে সময়ের সঙ্গে কি হারিয়েছে যেতে বসেছে থিয়েটারও ? কী বলছেন কলাকুশলীরা ?
এই বিষয়ে থিয়েটার নাট্যকার সুরজিৎ সেন বলেন, "আমি হতাশাগ্রস্ত নই ৷ আমি বরং আশাবাদী । আমি 1985 সাল থেকে এই থিয়েটারের গল্প লিখে যাচ্ছি । তখন তো খুব বেশি চাহিদা ছিল ৷ কিন্তু এখনও মফস্বল এলাকায় বহু দল রয়েছে যারা থিয়েটার ও নাটক করে চলেছে ।"
দর্শক থিয়েটারমুখী না হওয়ায় তিনি যদিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও মোবাইলকে দায়ী করেছেন । তাঁর বক্তব্য, দর্শকরা থিয়েটারমুখী না হয়ে বরং মনোরঞ্জনের জন্য এইসবের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে । সুরজিৎ খানিকটা দোষ চাপিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের উপরও । তাঁর মতে, সংবাদমাধ্যম থিয়েটার ছেড়ে বরং এই সিনেমা, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে । এর সঙ্গে থিয়েটারের মার্কেটিংও হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন ৷ তবে দর্শক যে কমেছে সেকথা স্বীকার করেছেন এই নাট্যকার ।
অভিনেতা বিশ্বজিৎ কুণ্ডু বলেন, "আগের মতন থিয়েটার ও নাটকের চাহিদা নেই । সিনেমা, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এর সঙ্গে ফোনের যুগে নামিদামী হিন্দি ও বাংলা-সহ টলিউড বলিউডের সিনেমা মুক্তি থিয়েটারের বাজার দখল করেছে এটা ঠিক ৷ কিন্তু বর্তমানে অ্যান্ড্রয়েড এবং ফার্স্ট লাইফের যুগে মানুষ ক্লান্ত হয়ে উঠেছে । তাই মানুষ আবার থিয়েটারমুখী হবে বলে আশাবাদী আমি । তরুণ প্রজন্ম সময়ের সঙ্গে দ্রুত চলতে পারছে না ৷ আর তারা তাই থিয়েটারমুখী হতে চাইছে । আগামী দিনে আবার সেই পুরনো দিনগুলি ফিরে পাব বলে আশা আমাদের ।"
আরও পড়ুন:বাড়ির উঠোনে পৌঁছে যাচ্ছে থিয়েটার
সালটা হবে 1970-80 এর দশক । সেই সময় এমনভাবে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের যুগ আসেনি ৷ না ছিল বড় এলইডি টিভি ৷ বরং ছিল মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম বেতার এবং থিয়েটার । থিয়েটার সেই সময় মানুষের কাছে ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম । এই থিয়েটারের সঙ্গে মেদিনীপুরের গ্রাম-গঞ্জে পাড়াগাঁয়ে অনুষ্ঠিত হত যাত্রাপালা, নাটক, কবিগান, বাউল । সাইড থেকে ডায়লগ বলা এবং সেই ডায়লগ আওড়ে হেসে কেঁদে মানুষের মনোরঞ্জনের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এই থিয়েটার । মানুষের সঙ্গে মানুষের আলাপচারিতার, ভাবভঙ্গি প্রকাশ, জলন্ত সমস্যা তুলে ধরার এক ও অভিনব উদ্যোগ এই থিয়েটার । জঙ্গলমহল পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা, শালবনি, চাঁদড়া, পিংলা,সবং,ঘাটাল ও দাসপুরে সেই সময় থিয়েটারে ভিড় জমাতো হাজার হাজার মানুষ ৷ কেবল একবার কলাকুশলীদের অভিনয় দেখার জন্য ।
এমনকী বড় বড় মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল এই থিয়েটারের জন্য । যেখানে কালো পর্দার পাশাপাশি অডিয়ো ভিস্যুয়াল যাতে ভালো আসে তার জন্য মাইক সিস্টেম ব্যবহার করা হত । কিন্তু সময়ের সঙ্গে এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে থিয়েটার আর এগোতে পারেনি। আস্তে আস্তে বেতার তরঙ্গ ছেড়ে অডিয়ো ভিসুয়াল চ্যানেল টিভি এবং পরবর্তীকালে সেই টিভির দৌলতে আস্তে আস্তে আরও আপডেটেড হয়ে আজকে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল । বর্তমানে ফাইভ-জিতে অভ্যস্ত হতে চলেছে এই জনজীবন ।
একসময় বড় বড় সিনেমা হলের স্ক্রিনেরও আজ অবলুপ্তি ঘটেছে । চলে এসেছে হাতের মুঠোয় ছোট স্ক্রিন এবং এরই সঙ্গে সিনেমা । বড় সিনেমার পাশাপাশি ওটিটি প্লাটফর্মে মুক্তি পাচ্ছে ছোট ও স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ । ফলে হারিয়েছে থিয়েটারের কলাকুশলীরা । কিন্তু এখনও প্রবীণ কিছু কলাকুশলীরা থিয়েটারের স্মৃতিকে আঁকড়ে অভিনয় করে চলেছে ৷ ইতিমধ্যে তরুণ থিয়েটারের নাম দিয়ে শহরের বিদ্যাসাগর মুক্ত মঞ্চে মাসে দু'দিন করে চলছে কর্মশালা ।
আরও পড়ুন:শহরজুড়ে বন্ধ সিনেমা, থিয়েটার হল! কিন্তু বছর বছর আসছে বিনোদন করের বিল
আগামী 30 অগস্ট মেদিনীপুরের রানি শিরোমণিকে নিয়ে নতুন করে এক নাটক হতে চলেছে । সেই 1 ঘণ্টা 10 মিনিটের নাটকে অংশ নিচ্ছেন প্রায় 74 জন শিল্পী । যার নাম দেওয়া হয়েছে মেদিনীপুরের 'বীরাঙ্গনা রানি শিরোমণি' । মূলত এই নাটকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে রানি শিরোমনির যে বীরাঙ্গনা রূপ, সেটিকে তুলে ধরা হবে ৷ সঙ্গে তুলে ধরা হবে তাঁর স্নেহ ভালোবাসার দিকটিও ।