2019-এ জঙ্গলমহল মূলত মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় বিজেপির দিকে ঝড় বইলেও এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর চিত্রটা একেবারে উল্টে গিয়েছে । তৃণমূল কংগ্রেস ফিরে পেয়েছে তার ভোট ব্যাঙ্ক ৷
বহু বছর ধরে সাংগঠনিকভাবে কাজ করলেও 2019-এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গের একদা মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি যেমন ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার কিছু অংশে ওঠে গেরুয়া ঝড় । গোটা ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়ার একটা বড় অংশ ও বাঁকুড়া জেলার মূলত রায়পুর রানিবাঁধ ও সারেঙ্গাতে ।
2018-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম ও পুরুলিয়া এই দু'টি জেলাতেই বিজেপি খুব ভালো ফল করে । 2019-এর লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপি আবারও ভালো ফল করে । তবে 2021-এর বিধানসভা নির্বাচনে তারা সেই ট্রেন্ডটা আর ধরে রাখতে পারল না । এই নির্বাচনে বিজেপি ওই অঞ্চলে একটা বিরাট ধাক্কা খেল । এবারের নির্বাচনে চিত্রটা একেবারে 180 ডিগ্রি ঘুরে গেল তৃণমূলের অনুকূলে ৷
কীভাবে তৃণমূল আবার ফিরে পেল নিজের ভোট ব্যাঙ্ক । এই প্রসঙ্গে মাওবাদীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন লেখক ('Lalgarh and the Legend of Kishanji: Tales from India's Maoist Movement' / 'Mission Bengal: A Saffron Experiment') ও প্রাক্তন সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য মনে করেন যে, ওই এলাকাগুলিতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে রক্ত রাগ জমেছিল, যা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নয়, স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে । কারণ 2011 সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আসার পর ওই অঞ্চলগুলোতে ব্যাপকভাবে উন্নয়নের কাজ হয়ে থাকলেও মানুষের ক্ষোভ ছিল স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য এবং সরকারের তরফে যে স্কিমগুলি আসছে তাতে নেতাদের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ । উন্নয়নের কাজে মানুষ খুশি হলেও, স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্যে সেখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন । মানুষ স্থানীয় নেতাদের দাদাগিরিতে অতিষ্ঠ হয়ে তৃণমূলের বিকল্প চেয়েছিলেন । তাঁরা তৃণমূলকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন । অন্যদিকে গত দু'বছরে ওই এলাকায় বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বেড়েছে ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর যে তৃণমূলকে ওই অঞ্চলে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করেছে সেটা হল, তৃণমূল ওখানকার সমস্ত স্থানীয় আদিবাসী সংগঠনগুলিকে যেমন ভারত জাকাত মাঝি মারওয়া, যেটি ওই অঞ্চলের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংগঠন তাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে আদিবসীদের উন্নতির জন্য কাজ করেছে । ওই অঞ্চলে তৃণমূল সারনা ধর্মকে একটি আলাদা ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে । অন্যদিকে বিজেপি আদিবাসীদের হিন্দু হিসাবে রেজিস্টার করাতে চেয়েছে । এই বিষয়টি ভীষণভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ওখানের আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্কের মধ্যে ।
2019-এ নির্বাচনের তৃণমূল কংগ্রেস এক্কেবারে মুখ থুবড়ে পড়ার পর নিজেদের ভুল বুঝে ব্যাপক সাংগঠনিক উন্নতি করে । প্রতিটি ব্লকে যে স্থানীয় মুখগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল সেই মুখগুলোকে সরিয়ে দেওয়া হয় । ব্লক নেতৃত্ব পরিবর্তন করা হয় । নতুন মুখ সামনে আনা হয় । ফলে স্থানীয় মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে সরে যেতে থাকে ।
বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ ড. সুভাষ সরকারের মতে, বাঁকুড়ায় অজিত মুর্মু হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে একজনকে বিজেপিতে যোগদান করানোয় আদিবাসীরা মনক্ষুণ্ণ হন ৷ এতে সিপিএম সক্রিয় হয়ে যায় ৷ নিজেরাই পরিকল্পিত ভাবে ভোটটাকে তৃণমূলের দিকে দিয়ে দেয় ৷ তারা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করেছে ৷ অন্যদিকে আবার তৃণমূল কংগ্রেসের দুয়ারে সরকার বা স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি প্রকল্পগুলি মানুষের উপর প্রভাব ফেলেছে ৷ জঙ্গলমহলের অধিকাংশ সরল মানুষ এইসব প্রকল্পগুলির চটকে ভুলে যান ৷ এসবে ভুলে যান তাঁরা ৷ এতেই এবারের বিধানসভা নির্বাচনে এই ফলাফল দাঁড়ায় ৷
এই বিষয় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, "মানুষকে সাময়িকভাবে ভুল বোঝানো যায়, চিরকালের জন্য তাদের ভুল বোঝানো যায় না । মানুষ দেখেছেন বাম জমানায় আমলাশোলে মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গেছেন । জঙ্গলমহলের চূড়ান্ত দুর্দশা ও সন্ত্রাস । যেমন কোনও উন্নয়ন হয়নি তেমনই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সন্ত্রাস । অন্যদিকে সেখানে তৃণমূল সরকার দু'টো কাজ করেছে । তারা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে উন্নয়নের কাজ করেছে । পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে । সন্ত্রাসের অবসান ঘটেছে ।’’ জঙ্গলমহলের পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। মহিলারা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দ্বারা বিরাটভাবে উপকৃত হয়েছেন । একসময় মাওবাদীরা বলেছিলে সশস্ত্র বিপ্লব; এবার তৃণমূল উন্নয়নের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে নিঃশব্দ বিপ্লব । পাশাপাশি ওখানকার মানুষ দেখেছেন মোদি সরকার তাঁদের জন্য কিছু করেনি । তাঁদের কোনও উন্নয়ন করেনি । তাই এবার তাঁরা মুক্ত হস্তে তৃণমূলকে আবার ভোট দিয়েছেন বলে জানান কুণালবাবু ।
আরও পড়ুন: জখম পায়ে বিজেপিকে গোলের মালা পরিয়ে বাংলার মসনদে মমতা