মেদিনীপুর, 26 জুন : কথায় আছে, যত রোগজ্বালা বৃদ্ধাবস্থায় ৷তাই বয়সকালে চিন্তাও বেশি ৷বয়সকালে তাই প্রয়োজন ভালোবাসার এক চিলতে রোদ্দুর ৷ চিকিৎসকেরাও জানাচ্ছেন,65 বয়সের বেশি মানুষদের কোরোনার সময়ে অনেক বেশি করে সর্তকতা প্রয়োজন ৷এজন্য সতর্ক ও সচেতন মেদিনীপুরের বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ। অপরদিকে বাইরে বের হতে না পেরে মুক্তির স্বাদ পাচ্ছেন না আবাসিকদের। স্বাধীনতা নষ্ট হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখন নিজেদের বাঁচার লড়াই বলে সব মেনে নিতে তৎপর আবাসিকেরাও । যদিও কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আমরা সচেতন ৷ কোনওভাবেই এখানে যাতে কোরোনার থাবা বসাতে না পারে সেই বিষয়ে আমরা সতর্ক ৷
স্বাধীনতার রোদ্দুরের অপেক্ষায় কোরোনা সংক্রমণ হয়েছে খড়গপুর পৌরসভার প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যানেরও ৷এই অবস্থায় বৃদ্ধাশ্রম পাহারা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ । এরকমই ঘটনা মেদিনীপুর শহরের নজরগঞ্জের আনন্দ আশ্রমের। 1992 সালের মাত্র 25 জন আবাসিকদের নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আনন্দ আশ্রম ৷ প্রয়াত বিধায়ক ডক্টর রজনীকান্ত দৌলুয়ের প্রচেষ্টায় সমাজের পিছিয়ে পড়া এবং বঞ্চিত মানুষদের কথা ভেবেই এই বৃদ্ধাশ্রমের সূচনা।এই বৃদ্ধাশ্রম 1992 সালে শুরু হয় ৷ বর্তমানে এখানে 42 জন আবাসিক। যারা ঘরের মানুষদের কাছ থেকে বঞ্চিত এই আনন্দ আশ্রম তাদের আশ্রয়। এই আশ্রমেই তারা খেলাধুলো, গল্প-গুজব, সেলাই করা, সোয়েটার বোনা, রান্না করা এবং গাছপালা যত্ন নেওয়ায় সময় কাটাচ্ছেন।মাঝে মাঝে গেটের দরজা পেরিয়ে বাইরে কিছু মুখরোচক খাবার কিনে খাওয়া। আশ্রমের গেটের বাইরে বেরিয়ে দই-মিষ্টি আইসক্রিম এবং চকলেট কিনে খাওয়া । এরকমই রোজনামচা চলছিল এই বৃদ্ধাশ্রমের । কিন্তু বাদ সাধলো কোরোনা সংক্রমণ। সংক্রমণ সময়ে দীর্ঘ লকডাউন ৷সেই লকডাউনের ঘরবন্দী আজ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ৷ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ বাইরে বের হতে ৷
কোরোনার থাবা তাদের বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের উপর যাতে কোনওভাবে পড়তে না পারে সে বিষয়ে কঠোর হতে হয়েছে আনন্দ আশ্রম কর্তৃপক্ষকে । কোনভাবেই আশ্রমের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না অজানা-অচেনা এবং পরিবার-পরিজনদের । লকডাউনের আগে কোনও স্পেশাল দিনে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের পক্ষ থেকে আবাসিকদের মিষ্টিমুখ করান হত, এমনকি ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হত। এখন সব বন্ধ ৷আবাসিকদের জন্য রান্নার কাজে আসা মাসীদের ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে বাইরে থেকে পরে আসা পোশাক সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে নতুন পোশাক পরে মুখে মাস্ক হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে ফেস শিল্ড লাগিয়ে তাদেরকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে এই আশ্রমে। তবে পরিবার-পরিজন, ছেলেমেয়ে স্বামী পুত্র থেকে বঞ্চিত হয়ে কোরোনা লকডাউনে আজ কোরোনা আতঙ্কে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা কিছুটা মনমরা ৷তবে এরই মধ্যে কেউ কেউ আবার কোরোনা নিয়ে কবিতা লিখছেন,গান তৈরি করছেন ৷ আশ্রম প্রতিষ্ঠাতা ডঃ রজনীকান্ত দৌলুয়ের জীবনী নিয়েও কেউ কেউ লিখছেন কবিতা।
আশ্রমের 60 বছর উত্তীর্ণ আবাসিক অশোকা মুখার্জি কোরোনা ভাইরাস নিয়ে কবিতায় লিখেছেন। "বিদেশ থেকে আসা রোগ কোরোনা ভাইরাস,নিয়মকানুন না মানলে হবে সর্বনাশ"৷ এই ভাবেই লিখেছেন কবিতা ৷ এই কবিতা দ্বারা শুধু জনমানসে নয় আবাসিকদেরও সতর্ক ও সচেতন করেছেন এই আবাসিক নিজে ৷ আবাসিকদের কথায়, এই কোরোনা ভাইরাস আমাদের স্বাধীনতা নষ্ট করেছে ঠিকই কিন্তু এখন আমরা লড়ছি নিজেদের বাঁচার জন্য। আরেক আবাসিক শক্তি বেরা বলেন, "দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছি কিন্তু এই কোরোনার সংক্রমণ এবং লকডাউনের অনেকটা প্রভাব পড়েছে আমাদের উপর। আমরা এখানে খাবার-দাবার সবই পাই ৷ কিন্তু কখনও কখনও ইচ্ছে করে দই-মিষ্টি চকলেট খেতে ৷ লকডাউনের জন্য সেগুলো পাচ্ছি না। " সতর্ক ও সচেতন থাকছেন তাঁরা ৷ সুধীরকুমার ধর ও পারুল বোস এই দুই আবাসিক বলেন "কোরোনা না থাকলে হয়তো আমরা একটু বাইরে ঘুরতে পেতাম৷ একটু বাইরের লোকজন দেখতে পেতাম।বাইরের প্রকৃতির নতুন স্বাদ পেতাম,সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমনিতেই আমরা ছেলেমেয়ের দ্বারা বিতাড়িত। তবে খুব খারাপ নেই আমরা, এর মধ্যেও মানিয়ে নিয়েছি।"
রজনীকান্ত দৌলুয়ের মৃত্যুর পর তা সামলে চলেছেন বর্তমান সম্পাদক সত্যব্রত দোলুই । তিনি বলেন, "এর আগে এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকা আবাসিকদের আমরা কোনও ভাবে কোন জায়গায় যেতে নিষেধ করিনি ৷ কিন্তু কোরোনার সংক্রমণের ভয় আমাদের মনেও বাসা বেঁধেছে । তাই কোরোনা সংক্রমণ যাতে কোনওভাবেই আমাদের আশ্রমের উপর থাবা বসাতে না পারে তাই আমরা সচেষ্ট।আমরা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছি। দফায় দফায় সংক্রমণ রোধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। যাতে এই শেষ বয়সে আসা আবাসিকদের আমরা সুস্থ রাখতে পারি।কারণ এই শেষ বয়সের দিকেই সাধারণত কোরোনায় সংক্রমণের বেশি প্রভাব থাকে তাই আমরা সচেষ্ট রয়েছি।" সহকারি সম্পাদক অশোক মালাকার । তিনি বলেন এখন বাচ্চাদের মতন তাদেরকে দেখভাল করতে হয়। একটু তো নির্দেশ রয়েছে একটু কঠোর হতে হয়েছে আমদের । তাদেরকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক রয়েছি।" পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই ধরনের বৃদ্ধাশ্রম নেই বললেই চলে। মোট 13 টি হোমের মধ্যে জেলায় বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা 3 টি। একটি দাঁতন একটি খড়গপুর ও একটি মেদিনীপুরে। এই বৃদ্ধাশ্রম বহুদিন ধরে চলে আসছে এই মেদিনীপুর জেলায়।একসময়ে আবাসিকদের সংখ্যা ছিল 25 জন ৷ যদিও বর্তমানে 42 জন আবাসিক রয়েছেন। কোনও সরকারি সাহায্য আসে না ৷ দীর্ঘ 6 বছর ধরে কোন ধরনের সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের।