আসানসোল, 15 অগাস্ট : একসময় খনি অঞ্চলে তাঁর ঘোড়ার খুরের শব্দে আতঙ্কিত হত ব্রিটিশ পুলিশরা । মুখে জ্বলত সিগার । হাতে চাবুক । খনি অঞ্চলে শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশ পুলিশদের নির্যাতনের খবর পেলেই তিনি ছুটে আসতেন । তারপর চাবুক বসিয়ে দিতেন ব্রিটিশ পুলিশদের পিঠে । এমন বীরাঙ্গনার গল্প ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে কালের নিয়মে । এখনকার প্রজন্ম আর জানতেও পারবে না তাঁর কথা । তিনি বিপ্লবী বিমল প্রতিভাদেবী । একসময় খনি অঞ্চলের হিন্দিভাষীরা যাঁকে বলতেন "হাঁটারওয়ালি মর্দানি ।" স্বাধীনতার জন্য লড়ে ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে তাঁর নির্বাসন হয় দামোদর নদীর মাঝে একটি দ্বীপে । একটি ছোট্ট ঘরে । কিন্তু, আজ আর সেই ঘর নেই ৷ দামোদরের স্রোতে ভেসে গেছে শেষ চিহ্ণটুকু । একইভাবে বিমল প্রতিভার ইতিহাসও ভেসে যাচ্ছে দামোদরের জলে ।
বিমল প্রতিভাদেবীর জন্ম হয়েছিল কটক শহরে । স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুখোপাধ্যায় পরিবারে জন্ম । তাই চেতনাতে স্বাধীনতা সংগ্রাম ঢুকে গিয়েছিল । পরবর্তীকালে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ । বিপ্লবীদের অস্ত্র পাচার, সরাসরি অস্ত্র চালানো, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য জমিদারদের বাড়ি লুট আরও বহু গল্প শুনতে পাওয়া যায় । শোনা যায় ভগৎ সিং তাঁর নওজোয়ান সংঘ দলের জন্য পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই বিমল প্রতিভাদেবীকে । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বোনের সঙ্গেও বিমল প্রতিভার ভালো ছিল সম্পর্ক ছিল । স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন তিনি ৷ কিন্তু, নরমপন্থী রাজনীতি তাঁর ভালো লাগত না । তাই বেরিয়ে এসে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন । পরবর্তীকালে শ্রমিক আন্দোলনে উৎসাহিত হন । কয়লা খনি অঞ্চলে শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন । ব্রিটিশদের হাতে অত্যাচারিত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি ।
বিপ্লবী বিমল প্রতিভা দেবীর নামে ফলকটিই শুধু পড়ে রয়েছে শোনা যায়, খনি অঞ্চলে ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়াতেন তিনি । সঙ্গে থাকত চাবুক । সব সময় ঠোঁটে ঝুলত সিগার । শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশদের অত্যাচারের খবর পেলে ছুটে যেতেন এবং উদ্ধার করতেন শ্রমিকদের । বীরত্বের জন্য তাঁকে "হান্টারওয়ালি মার্দানি" বলেও সম্বোধন করত হিন্দিভাষী শ্রমিকরা । কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়েন এবং তার নির্বাসন হয় দামোদর নদীর মাঝে একটি দ্বীপে । দামোদর স্টেশনের পাশেই নদীর মাঝে একটি দ্বীপের মধ্যে একটি ছোট্ট ঘরে তাঁকে নির্বাসিত করা হয় । স্বাধীন হওয়ার পর অবশ্য তিনি ঢাকেরশরী এলাকায় চলে আসেন । এই অঞ্চলের মানুষেক পাশে ছিলেন সবসময় । এখানকার মানুষজনও তাঁকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিল । তাই আর এই এলাকা ছেড়ে কোথাও যাননি । মৃত্যু হয়েছিল ঢাকেশ্বরীতেই এবং দামোদরেই তাঁর সৎকার করা হয় ।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, এই বিমল প্রতিভার কোনও ছবি বা ঐতিহাসিক চিহ্ন কিছুই আর নেই । কালের নিয়মে সবই হারিয়ে গেছে । শুধুমাত্র দামোদর স্টেশন থেকে ঢাকেশ্বরী যাওয়ার রাস্তাটিকে বিমল প্রতিভার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে । আগে সেখানে একটি নামফলক ছিল । বর্তমানে সেটিও ভেঙে পড়ে রয়েছে । স্থানীয় একটি ক্লাবের উদ্যোগে একটি বোর্ড লাগানো হয়েছে মাত্র । এলাকার এই প্রজন্ম তাঁর নাম শোনেনি । পুরোনো আমলের কয়েকজন রয়েছেন যাঁরা তাঁকে দেখেছেন । তেমনি একজন হলেন মহাদেব কর । মহাদেববাবু জানালেন "আমি দেখেছি তাঁকে । কী দাপট ছিল তাঁর । সব সময় সিগারেট খেতেন । হাতে একটি পিস্তল থাকত । এখানেই থাকতেন । শেষ জীবনে খুব কষ্ট পেয়ে মারা যান।"
হারিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবী বিমল প্রতিভার ইতিহাস ওই এলাকার আর এক বাসিন্দা সুমঙ্গলময় লাহিড়ি জানালেন, "আমার বাবার সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল । আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসতেন । আমার মা যেহেতু স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেই কারণে মাঝেমধ্যে এসে গল্প করতেন ।" স্মৃতিতে যেটুকু আছে সেটুকুই বলতে পারেন এখন ঢাকেরশরী দামোদর এলাকার বাসিন্দারা । কিন্তু ইতিহাস মুছে যাচ্ছে । যেভাবে বিমল প্রতিভা দেবীর নির্বাসিত স্থান, সেই বাড়ি সবকিছুই আজ ধুলিস্যাৎ বা দামোদরের গর্ভে চলে গেছে । এমনি হয়ত কালের নিয়মে মুছে যাচ্ছে বাংলার এই বীরাঙ্গনার গল্পও ।