বহরমপুর, 15 অক্টোবর : এই মাসের 5 তারিখ । জিয়াগঞ্জে বোনের বাড়িতে আসে উৎপল বেহরা । সেদিন স্টেশন থেকেই একটি অস্ত্র কিনেছিল সে । যদিও সেদিন রাতেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল ।
কে এই উৎপল ?
আদতে পেশায় রাজমিস্ত্রি উৎপল বেহরা । বাড়ি মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি ।
7 অক্টোবর ফের একবার উৎপল ফিরে আসে জিয়াগঞ্জে । বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির খোঁজ না মিললেও সেদিন চারপাশটা ভালো করে বুঝে নিয়েছিল । ঠিক পর দিন 8 তারিখ সকাল 10 টা 37 মিনিট । বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করে বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়েছিল উৎপল । কেন ঠিকানা জানতে চেয়েছিল সে, মনে বিন্দুমাত্র কোনও সংশয় আসেনি বন্ধুপ্রকাশের । এরপরই ঠিকানা জেনে বন্ধুপ্রকাশের বাড়িতে হানা দিয়েছিল উৎপল ।
দুপুরে দরজার কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলেছিলেন বন্ধুপ্রকাশ । কাজ হাসিল করতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি উৎপল । প্রথমে বন্ধুপ্রকাশ, তারপর তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, তারপর তাঁদের একমাত্র সন্তান আর্য । টার্গেট সম্পূর্ণ করল উৎপল । তিনটি খুন করার পর হাত, জামাকাপড় সবই তার রক্তাক্ত । ঠিক তখনই আর একটি বেলের শব্দে চমকে উঠেছিল ধুরন্ধর খুনি উৎপল । জানালা দিয়ে নজরে আসে দুধ দিতে এসেছে দুধওয়ালা । দেহগুলি সরানোর সুযোগ পায়নি সে । বাধ্য হয়ে দেহগুলো ফেলে পালিয়ে যায় উৎপল । রক্তমাখা পোশাক ও ধারালো অস্ত্র পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয় । আর অতি সাধারণ পোশাকে গা ঢাকা দেয় সে । জিয়াগঞ্জে খুনের ঘটনায় কিনারা করতে গিয়ে এমনই তথ্য জানাল পুলিশ ।
কিন্তু কী কারণে এই খুন ? তদন্তকারী অফিসাররা জানাচ্ছেন খুনের মোটিভও ।
বন্ধুপ্রকাশ পেশাগত ক্ষেত্রে শিক্ষকতা করলেও বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার হয়েও কাজ করতেন । উৎপলের সঙ্গে সেই সূত্রেই বন্ধুপ্রকাশের যোগ । পুলিশ জানিয়েছে, বাৎসরিক 24 হাজার টাকার কিস্তির বিনিময়ে বন্ধুপ্রকাশের কাছে একটি বিমা করেছিল উৎপল । আর এই বিমা ঘিরেই যাবতীয় বিতর্কের সূত্রপাত । পুলিশের জেরায় উৎপল জানিয়েছে, বিমার প্রথম কিস্তির রসিদ বন্ধুপ্রকাশ দিয়েছিলেন । কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় কিস্তির রসিদটি দেননি বন্ধুপ্রকাশ । তাই গত চার মাস ধরে রসিদ দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছিল উৎপল । কিন্তু তাতেও কোনও কাজ হচ্ছিল না । উলটে বন্ধুপ্রকাশ গালিগালাজ করেছিলেন বলে জেরায় জানায় উৎপল । আর তারপরই বন্ধুপ্রকাশকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় সে ।
ঠিকভাবেই এগিয়েছিল উৎপলের ছক । প্রথমে বাড়ির এলাকা চেনা, কখন বন্ধুপ্রকাশ বাড়িতে থাকবে তার খোঁজ নেওয়া, এসব তথ্য ঠিকমতো জোগাড়ও করে ফেলেছিল । কিন্তু কথায় বলে অপরাধী একটি ভুল সব শেষ করে দেয় । এখানে হয়তো উৎপলের ফেলে যাওয়া ব্যাগ এবং তার থেকে উদ্ধার হওয়া রক্ত লাগা বিমার কাগজ পুলিশের সন্দেহ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় । সেই সন্দেহকে কয়েকগুণ বাড়িয়েছিল বিউটিপালের কললিস্ট ।
পুলিশ জানিয়েছে, পাঁচ মিনিটে তিনটি খুন করে উৎপল । বিউটির ফোনকলের তালিকা অনুযায়ী ঘটনার দিন দুপুর 12 টা 3 মিনিট থেকে 12 টা 6 মিনিটে বিউটি তিনি কারও সঙ্গে ভিডিয়ো কলে কথা বলেন । তখনও তাঁরা বেঁচে ছিলেন । অন্যদিকে তদন্তে জানা যায়, ঘটনার দিন 12 টা 11 মিনিটে বন্ধুপ্রকাশের বাড়িতে ওই দুধওয়ালা আসে । যাকে দেখে উৎপল পালিয়ে যায় । তাই পুলিশের দাবি, 12 টা 6 মিনিট থেকে 12 টা 11 মিনিটের মধ্যেই উৎপল তিনজনকে খুন করে ।
কী জন্য খুন করেছিল উৎপল ? ভিডিয়োয় শুনুন বক্তব্য জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার জানান, তদন্তের স্বার্থে বন্ধুপ্রকাশের ফোনের তালিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছিল । সেখানে একটি নম্বর চোখে পড়ে । এই নম্বর থেকেই ঘটনার দিন বন্ধুপ্রকাশকে ফোন করা হয় । এরপরেই নম্বরের ব্যবহারকারীর খোঁজ শুরু করে পুলিশ । এছাড়া, বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি থেকে পুলিশ যে জিনিসগুলি উদ্ধার করে তাতে একটি রক্তমাখা বিমার কাগজ ছিল । তাতেই নাম উঠে আসে সাগরদিঘির উৎপল বেহরার । এরপরই উৎপলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় । জিজ্ঞাসাবাদে উৎপল জানায়, ঘটনার দিন সে সাগরদিঘিতে ছিল । কিন্তু উৎপলের ফোন লোকেশন ট্র্যাক করে পুলিশ জানতে পারে ঘটনার দিন সে জিয়াগঞ্জে ছিল । এরপরই পুলিশের সন্দেহ হয় । দফায় দফায় জের করা হয় উৎপলকে । পুলিশের জেরার মুখে ভেঙে পড়ে সে, এমনটাই জানান মুকেশ কুমার ।
শুধুই কি উৎপলের রক্তমাখা বিমা কাগজ সন্দেহ বাড়িয়েছিল পুলিশের ?
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, সেদিন বন্ধুপ্রকাশের ঘর থেকে বেশ কিছু রক্তমাখা বিমার কাগজ উদ্ধার করা গেছিল । সেখান থেকেই উৎপলের পাশাপাশি কিছু নাম সামনে আসে । তদন্তের স্বার্থে তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ডেকে পাঠানো হয় থানায় । দফায় দফায় চলে জিজ্ঞাসাবাদ । উৎপলের পাশাপাশি ছিল তার বাবাও । কিন্তু একমাত্র উৎপলের উত্তরের মধ্যেই বেশ কিছু অসঙ্গতি নজরে আসে । আর তাতেই সন্দেহ তীব্র হয় । আলাদা করে উৎপলকে জিজ্ঞাসা করার চিন্তা মাথায় আসে পুলিশের । দফায় দফায় প্রশ্ন করতেই ভেঙে পড়ে খুনি উৎপল । স্বীকার করে 5 মিনিটের মধ্যে তিনটি খুন করেছে সে । বিমার কাগজ নিয়েই যে অশান্তি সে কথাও জানায় উৎপল । একইসঙ্গে স্বীকারোক্তি ছিল, বন্ধুপ্রকাশ কুকথা বলায় ধৈর্য ঠিক রাখতে পারেনি সে । তখনই বন্ধুপ্রকাশকে শাস্তি দেওয়ার ছক কষে । সেইমতো এগোতে শুরু করে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ।
মুকেশ কুমার জানান, উৎপল ও বন্ধুপ্রকাশ দু'জনের বাড়িই সাহাপুরে । তাই উৎপলকে বিউটি ও বন্ধুপ্রকাশের পরিবারের সকলেই চিনত । সেই কারণেই বন্ধুপ্রকাশের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকেও খুন করে উৎপল ।
যদিও বিউটির বাবা-মায়ের বক্তব্য, ''CBI তদন্ত চাই । উৎপল আসল খুনি নয় ৷''