মালদা, 30 মে: উজির হোসেন ৷ দিন প্রতি তাঁর আয় দু'শো থেকে তিন'শো টাকা । দিনে গেরস্থালির কাজ করেন, বিকেল হলে বাড়ির সামনে চপ-মুড়ির দোকান দেন । তাঁর মেয়েই এবার হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম হয়েছে । খবরটা পেয়ে আনন্দ যেন আছড়ে পড়েছে উজির হোসেনের ঘরে । মেয়ের গর্বে চোখে জল তাঁর । আবেগে গলা বুঁজে যাচ্ছে মেয়েরও ।
সোমবার 2022 সালের মাদ্রাসা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে (WB Madrasah Exam Result) । পরীক্ষা শেষ হওয়ার 40 দিনের মাথায় হাই মাদ্রাসা, আলিম ও ফাজিল পরীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে রাজ্য মাদ্রাসা বোর্ড । এবার হাই মাদ্রাসায় পাসের হার 87.02 শতাংশ । আলিমে 89.67 এবং ফাজিলে 90.03 শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে । মাদ্রাসা বোর্ডের প্রকাশিত মেধা তালিকা অনুযায়ী এবার হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম দশটি স্থানে জায়গা পেয়েছে 15 জন পড়ুয়া । তার মধ্যে 10 জনই মালদা জেলার ।
এই তালিকা অনুযায়ী রাজ্যে প্রথম হয়েছে রতুয়া 2 নম্বর ব্লকের বটতলা আদর্শ হাই মাদ্রাসার ছাত্রী শরিফা খাতুন । তার প্রাপ্ত নম্বর 786 ৷ ওই মাদ্রাসারই ইমরানা আফরোজ 775 নম্বর পেয়ে রাজ্যে দ্বিতীয় হয়েছে । 773 নম্বর পেয়ে রাজ্যে যুগ্ম তৃতীয় রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের রামনগর হাই মাদ্রাসার ছাত্র মহম্মদ ওয়াকিল আনসারি এবং কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকের দারিয়াপুর বাইশি হাই মাদ্রাসার আজিজা খাতিন । গাজোলের রামনগর হাই মাদ্রাসার ছাত্রী রৌনক জাহান 771 নম্বর পেয়ে রাজ্যে চতুর্থ স্থান পেয়েছে । 769 নম্বর পেয়ে রাজ্যে পঞ্চম স্থান পেয়েছে কালিয়াচকের এনএমএস হাই মাদ্রাসার সানিয়া পারভিন । 765 নম্বর পেয়ে যৌথভাবে নবম স্থান পেয়েছে রতুয়া ভগবানপুর হাই মাদ্রাসার মনীষা ইসলাম ও কালিয়াচকের এনএমএস হাই মাদ্রাসার আশিকা খাতুন । বটতলা আদর্শ হাই মাদ্রাসার দুই ছাত্রী মাহিদা খাতুন ও আঞ্জুমানারা 763 নম্বর পেয়ে রাজ্যে দশম স্থান অধিকার করেছে ।
মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম মালদার শরিফা খাতুন আরও পড়ুন : 100 দিনের কাজে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে পুরুলিয়ার প্রশাসনিক বৈঠক থেকেও সরব মুখ্যমন্ত্রী
সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মেয়েকে পড়িয়ে যাচ্ছেন রাজ্যে প্রথম হওয়া শারিফা খাতুনের বাবা উজির হোসেন । মেয়ের সাফল্যে গর্বিত তিনি । মেয়ে চায়, বড় হয়ে সে চিকিৎসক হবে । নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করেও মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে তৈরি তিনি । উজির সাহেবের কথায়,“আজ সকালে একজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে মালদা চলে গিয়েছিলাম । শিক্ষকদের ফোনে জানতে পারি, মেয়ে রাজ্যে প্রথম হয়েছে । মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভাল । ও কখনও সময় ধরে পড়াশোনা করে না । যখন সময় পায়, তখনই পড়তে বসে যায় । অনেকদিন ধরেই আশায় ছিলাম, মেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করবে । আমার যত কষ্টই হোক, মেয়ের জন্য কখনও কোনও অভাব রাখিনি । সামান্য আয়ে ওর দু'টো গৃহশিক্ষকও রেখেছিলাম । আমি ওকে বলেছি, ওকে ডাক্তার করতে প্রয়োজনে আমি আমার যাবতীয় সম্পত্তি বিক্রি করে দেব । মুখ্যমন্ত্রী একটু সাহায্য করলে আমি মেয়েটাকে মানুষ করতে পারব ।”
নিজের এই সাফল্যে শরিফা বলেছে, “আমি আসলে ভাদো মুসলিম গার্লস মিশনে পড়াশোনা করেছি । পরীক্ষা দিয়েছি বটতলা আদর্শ হাই মাদ্রাসা থেকে । জানতাম, প্রথম দশের মধ্যে থাকব । সবাই আমাকে সেকথা বলতেন । কিন্তু একেবারে যে বোর্ডে প্রথম হব, তা কখনও ভাবিনি । আজ আমি খুব আনন্দিত । আমি সবার মান রাখতে পেরেছি । আমার বাবা তেমন শিক্ষিত নন । ঝালমুড়ির দোকান চালান । কিন্তু তিনিই আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ জুগিয়েছেন । বড় হয়ে আমি স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ হতে চাই । আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় । তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন, আমি যেন উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর কাছ থেকে সাহায্য পাই ।” রাজ্যে এবারের হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় দ্বিতীয় ইমরানা আফরোজের বাড়ি শরিফার বাড়ির কাছেই । ইমরানার বাবা আখতার সাহেব জানান, “মেয়ে প্রথম থেকেই চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে । চার ছেলেমেয়েকে পড়াতে প্রতি মাসে আমার 40 থেকে 50 হাজার টাকা খরচ হয়ে যায় । তবে যেভাবেই হোক, মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে তাকে সহযোগিতা করে যাব ।"
ভাদো মুসলিম গার্লস মিশনের চার পড়ুয়া এবার হাই মাদ্রাসা পরীক্ষার মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছে ৷ এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাসুদ আলম বলেন, “এবার আমাদের মিশন থেকে চারজন হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় রাজ্যে প্রথম দশটি স্থানের মধ্যে রয়েছে । আমাদের মিশনের ছাত্রীরা বটতলা আদর্শ হাই মাদ্রাসা এবং বৈদ্যনাথপুর হাইস্কুল থেকে মাদ্রাসা ও মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় । এবার হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় শারিফা খাতুন ও ইমরানা আফরোজা যতাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় হয়েছে । শারিফা প্রথম থেকে এখানে পড়ে । ইমরানা সপ্তম শ্রেণিতে এখানে ভর্তি হয় । এছাড়াও এই মিশনের ছাত্রী মাহিদা খাতুন নবম এবং আঞ্জুমানারা খাতুন দশম হয়েছে । আগামীতেও আমরা সবাই এই মিশনের ছাত্রীদের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব ।”