মালদা, 13 সেপ্টেম্বর : বয়স 25 । ছোট থেকে নেশা খেলার মাঠে দৌড়োনো । সেই দৌড়েই চলত জীবনযাপন । শুধু নিজের নয়, পরিবারের চাকাটাও ঘুরত ওই নেশার দৌড়ে । কিন্তু কোরোনা থমকে দিয়েছে সেই চাকা । লকডাউন শুরুর পর থেকে এখনও বন্ধ খেলার মাঠ । বন্ধ রোজগারও । তাই কখনও অন্যের জমির ধানচাষ দেখাশোনা করা, কখনও বা অন্যের জমি থেকে কচু তুলে কিছু উপার্জন করা । কয়েক মাস ধরে এটাই রাজকুমারের দিন গুজরানের কাহিনি ।
রাজকুমার সিংহ । তাইকোন্ডো ব্ল্যাক বেল্ট প্রাপক । বাড়ি মালদা শহর থেকে 27 কিলোমিটার দূরে গাজলের প্রত্যন্ত ছোটা কাঁদর গ্রামে । সত্তরোর্ধ্ব বাবা শংকর সিংহ বিভিন্ন রোগভোগে ন্যুব্জ । কাজকর্ম দূরের কথা, বাড়ি থেকে ঠিকমতো বেরোতেও পারেন না । বাড়িতে বাবা, মা রিনাদেবী সিংহ ছাড়াও রয়েছে আরও দুই ভাই । তার মধ্যে রামকুমার কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে এখন সংসারের হাল ধরতে লড়াই শুরু করেছে । ছোট ভাই নীলেশ এবারই কলেজে ভরতি হয়েছে । তার লেখাপড়ার দায়িত্বটাও নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে রাজকুমারকে । ছোটো থেকেই মাঠের প্রতি নেশা । প্রথমে জিমন্যাস্টিকে হাতে খড়ি । কিন্তু ওই খেলার খরচ অনেক পরিকাঠামোও তেমন নেই । অগত্যা সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছে রাজকুমারকে ।
কলেজে পড়ার সময় 2012 সালে কোনও একদিন কাজে মালদা শহরে আসতে হয়েছিল তাঁকে । শহরের রাস্তায় হঠাৎ নজরে পড়ে, ল্যাম্পপোস্টে একটি ছেঁড়া ফ্লেক্স । সেখানে তাইকোন্ডো প্রশিক্ষণের কথা লেখা ছিল। সঙ্গে দেওয়া ছিল একটি ফোন নম্বর । সেই সময় রাজকুমারের নিজের ফোন ছিল না । অন্য একজনের ফোন নিয়ে ফ্লেক্সে দেওয়া নম্বরে ফোন করেন । এভাবেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাইকোন্ডো ক্যাম্প অফ বেঙ্গল এরিনার সম্পাদক রামশিস দাসের । তিনি তাইকোন্ডো প্রশিক্ষকও । রামশিসবাবুর কাছে তাইকোন্ডো প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন রাজকুমার । পরে এই ক্ষেত্রে কার্যত ইতিহাস গড়েন তিনি ।
ছোটা কাঁদর গ্রামে রেলের জমিতে টিনের বাড়ি । কোরোনা আবহে বাড়ির উঠোনেই এখন অনুশীলন চলছে রাজকুমারের । তিনি বলেন, “ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি নেশা । জিমনাস্টিক ও তাইকোন্ডো নিয়ে থাকতাম । এখনও সেই নেশা রয়েছে । বিভিন্ন স্কুল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে শিক্ষার্থীদের তাইকোন্ডো শিখিয়ে সংসার চালাতাম । কিন্তু কোরোনার জন্য সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে । আয়ের কোনও সংস্থান নেই ।" তিনি আরও বলেন, “আমরা অভাবী সংসারে মানুষ । ফলে বাসে চেপে প্রতিদিন মালদা যাওয়ার সামর্থ এখনও নেই । ভোর সাড়ে তিনটেয় বাড়ি থেকে সাইকেলে মালদা শহরে রওনা দিতাম । 27 কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে রামশিস স্যারের কাছে গিয়ে ট্রেনিং শেষ করে ফের সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতাম । এখনও সেভাবেই আমার ট্রেনিং চলে । রামশিস স্যার আমাকে নিয়মানুবর্তিতা শিখিয়েছেন । আরেকজন হরি স্যার। তিনি আমাকে জিমন্যাস্টিকের প্রশিক্ষণ দিতেন ।"
নিজের সাফল্য সম্পর্কে রাজকুমার বলেন, "আমি ওয়ার্ল্ড তাইকোন্ডো কুকেন সাউথ কোরিয়া থেকে ব্ল্যাক বেল্ট হয়েছি । তাইকোন্ডোর মূল জায়গা সেটাই । তবে কোরোনার জন্য আমার পরিস্থিতি এখন খুব খারাপ । বাইরে কোথাও যেতে পারছি না । কোথাও প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না । পেট চালাতে আমি এখন অন্যের জমিতে কাজ করি । পারিশ্রমিক হিসাবে কিছু টাকা আর খাবার জোগাড় হয়ে যাচ্ছে । এভাবেই দিন কাটছে । তবে কোরোনা পরিস্থিতি এমন ভাবে চলতে থাকলে আমার মতো লোকজনের অসম্ভব সমস্যা দেখা দেবে ।"
রাজকুমারের প্রশিক্ষক রামশিস দাস বলেন, “রাজকুমার খুব কষ্ট করেই তাইকোন্ডো শেখে । গাজল থেকে বাসে প্রতিদিন মালদা আসার সামর্থ্য নেই তার । তাই সাইকেলেই প্রতিদিন বাড়ি থেকে মালদা শহর যাওয়া আসা করে । অর্থাৎ প্রতিদিন ওকে 54 কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয় । কোরোনা হানা দেওয়ার আগে সে কিছু স্কুল ও ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তাইকোন্ডো শেখাত । সেখান থেকে অল্প যা সাম্মানিক পেত, তাতে কোনওরকমে দিন চলে যেত । কিন্তু কোরোনার জন্য এখন সব বন্ধ হয়ে গেছে । ফলে তার সমস্ত উপার্জনও বন্ধ । তাই এখন অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করে দিন কাটাচ্ছে । প্রতিদিন সুষম আহারটুকুও জোটাতে পারছে না । জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কিছু পদক পেয়েছে । তাইকোন্ডো ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ার অধীনে মেডেল পেয়েছে । বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চ্যাম্পিয়নশিপেও পদক পেয়েছে । ইন্দো-ভুটান আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক লাভ করেছে । তাইকোন্ডো এশিয়াডেও মেডেল পেয়েছে । খুব ভালোভাবেই ও এগিয়ে যাচ্ছিল । কিন্তু কোরোনা আবহে এখন কৃষি শ্রমিকের কাজ করা ছাড়া তার কোনও গতি নেই ।"
শুধু রাজকুমার নয়, গোটা দেশে তাঁর মতো আরও অনেক ছেলেমেয়ে এমন পরিস্থিতির শিকার । রাজকুমারের কোচের দাবি, "আমরা চাই, এই সমস্ত খেলোয়াড়দের জন্য সরকার কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করুক । যাতে তারা এই পরিস্থিতিতে অন্তত নিজেদের প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারে ।"