মালদা, 18 মে : 4 দিনের অচলাবস্থার সাময়িক পরিসমাপ্তি । শাসকদলের নেতাদের আশ্বাসে নিজেদের লাগাতার ধরনা ও আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে নিল গৌড়বঙ্গের পড়ুয়ারা । গতকাল বিকেলে জেলা তৃণমূলের এক প্রতিনিধিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলে । পড়ুয়াদের অভিযোগগুলি শোনার পর সরকারিভাবে সেসবের যথাযথ তদন্ত ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় । এরপরই 4 দিন ধরে চলা লাগাতার আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয় পড়ুয়ারা । তবে তারা জানিয়ে দেয়, শাসকদলের আশ্বাসে এই আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করলেও দাবি পূরণ না হলে ফের আন্দোলনে নামবে তারা ।
ঘটনার সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে এক ছাত্রের ভরতিকে কেন্দ্র করে । পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগে ভরতি হতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত অ্যালায়েড সাবজেক্টে অনার্স থাকতেই হবে । সেই তালিকায় জ়ুলজি বিষয় ছিল না । কিন্তু জ়ুলজি অনার্স থাকলেও মহম্মদ ফরিদ মণ্ডল নামে এক ছাত্রকে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগে ভরতি নেওয়া হয় । শুধু তাই নয়, ওই একজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তড়িঘড়ি এগজ়িকিউটিভ কাউন্সিলের (EC) বিশেষ বৈঠক ডাকে । সেই বৈঠকে ওই ছাত্রকে ভরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । পড়ুয়াদের অভিযোগ, সম্পূর্ণ নিয়ম না মেনে ওই ছাত্রকে ভরতি নেওয়া হয়েছে ।
ভিডিয়োয় মৌসম নুরের বক্তব্য এনিয়ে গত শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অভিযোগ জানাতে যান পড়ুয়ারা । সেদিন উপাচার্য কিংবা ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন না । পড়ুয়ারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সপেক্টর অফ কলেজেসকে নিজেদের অভিযোগ জানান । মঙ্গলবার উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে ছাত্রছাত্রীরা এই ইশু নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান । কিন্তু এই ইশুতে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'দল পড়ুয়ার বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে । উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে বলে সরব হয় পড়ুয়াদের একাংশ । তারা অভিযোগ করে, উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের নির্দেশে গুন্ডারা তাদের উপর হামলা চালিয়েছে । মেয়েদের গায়ে হাত তোলা হয়েছে । এনিয়ে তারা মঙ্গলবার দুপুর থেকে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক আধিকারিক, অধ্যাপক, শিক্ষাকর্মী সহ অশিক্ষক কর্মীদের উপাচার্যের ঘরে ঘেরাও করে রাখে । প্রায় 10 ঘণ্টা পর, সেদিন রাতে পড়ুয়ারা ফের দাবি করে, উপাচার্যের ঘরের বাইরে খোদ রেজিস্ট্রার এক ছাত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন । অন্যদিকে রেজিস্ট্রারও অভিযোগ করেন, বাংলা বিভাগের এক ছাত্র তাঁর গায়ে হাত তুলেছে । এই অভিযোগ ছড়িয়ে পড়তেই ছাত্র বিক্ষোভ আরও বড় আকার নেয় । অসুস্থ হয়ে পড়েন উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার । রাতে তাঁদের ভরতি করা হয় মালদা মেডিকেলে । এই ইশুতে সেদিন মাঝরাতে ইংরেজবাজার থানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে অভিযোগ দায়ের করা হয় । পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষাকর্মী সহ পড়ুয়াদের একাংশ শহরে মৌন মিছিল করেন । তাঁরা গোটা ঘটনাটি লিখিতভাবে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে জানিয়ে যথাযথ তদন্তের আবেদন জানান ।
এতকিছু চলতে থাকলেও উপাচার্যের ঘরে নিজেদের অবস্থান বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিল আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা । এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পঠনপাঠন ও কাজকর্ম শিকেয় ওঠে । গতকাল বিকেলে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করতে আসে তৃণমূলের এক প্রতিনিধিদল । সেই দলে ছিলেন উত্তর মালদার বিদায়ি সাংসদ মৌসম নুর, ইংরেজবাজারের বিধায়ক নীহাররঞ্জন ঘোষ, জেলা তৃণমূলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি দুলাল সরকার, যুবনেতা অম্লান ভাদুড়ি, সুমালা আগরওয়াল প্রমুখ । তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলেন । পড়ুয়াদের বক্তব্য, তাদের দাবি সরকারিভাবে খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে । এরপরই নিজেদের 4 দিনের আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে নেয় পড়ুয়ারা ।
দুলালবাবু বলেন, "ছাত্র ও অধ্যাপকদের বিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকদিন ধরে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল । অসুস্থ হয়ে উপাচার্যকে হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছিল । নিজেদের দাবিতে ছাত্ররাও অনড়ভাবে ধরনা চালিয়ে যাচ্ছিল । তাদেরও কয়েকজনের শরীর খারাপ হয়ে গেছে । হাসপাতালে ভরতি করতে হয়েছে । গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ নজর রয়েছে । এই জেলায় আমাদের অবজ়ারভার শুভেন্দু অধিকারী । জেলার প্রতিটি বিষয় তাঁর নজরে নিয়ে যেতে হয় । বিষয়টি জেনে তিনিও আমাদের সমস্যা মেটানোর নির্দেশ দিয়েছেন । তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অধ্যাপক ও পড়ুয়াও ব্যক্তিগতভাবে এই সমস্যা মেটানোর জন্য আমাদের জানান । ২১ তারিখ থেকে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শুরু হচ্ছে । এসব দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতে আসি । আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে তারা নিজেদের আন্দোলন তুলে নিয়েছে । আগামী দিনে এনিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করব । যে ঘটনা ঘটেছে, তা ভুল বোঝাবুঝি থেকেই হয়েছে বলে আমাদের অনুমান ।"
মৌসম বলেন, "কয়েকদিন ধরে দেশের অন্যতম নামকরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা চলছে । একটি ছাত্রের ভরতি নিয়ে পড়ুয়াদের এই আন্দোলন । গোটা বিষয়টি আমরা শুভেন্দু অধিকারী ও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে জানিয়েছি । তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সবাই পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আমরা পড়ুয়াদের আবেদন করেছি । তাদের অভিযোগ মেটানোর জন্য আমরা আশ্বাস দিয়েছি । আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে পড়ুয়ারা আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে । উপাচার্যকেও আমরা বলব, কোনও সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তা যেন তিনি সমাধান করে নেন । এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছেও যেতে পারি ।"
আন্দোলনকারী এক ছাত্র বাপ্পা দাস বলেন, "শাসকদলের ভরসাতেই আমরা নিজেদের আন্দোলন সাময়িক প্রত্যাহার করলাম । আমাদের প্রশ্ন, জ়ুলজি অনার্সের এক ছাত্রকে কী ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসপেক্টাসের বাইরে গিয়ে ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনে ভরতি নেওয়া হল? ওই একজন ছাত্রের ভরতি নিয়ে EC বৈঠক ডাকতে হল কেন? তাছাড়া এই ইশু নিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে কোনও সহযোগিতা করেননি । উলটে রেজিস্ট্রার মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছেন । তার ভিডিয়ো ফুটেজ আমাদের হাতে রয়েছে । এছাড়া একাধিক অধ্যাপক গুন্ডা এবং অন্য বিভাগের ছাত্রদের দিয়ে আমাদের উপর হামলা করিয়েছেন । শুধু তাই নয়, আমাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে অসহযোগিতা করা হচ্ছে । দেড় বছর ধরে কোনও হস্টেল তৈরি হচ্ছে না । উপাচার্য ও রেজিস্ট্রার লবিবাজিতে বিশ্বাস করেন । বিভিন্ন বিভাগের প্রধানদের দিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ভয় দেখাচ্ছেন । আমরা যদি কোনও অন্যায় করে থাকি, তবে আমাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হোক । আমাদের দাবি, এই আন্দোলন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেন ।"