মালদা, 26 জুন : কোরোনা মোকাবিলায় প্রায় তিন মাস ধরে চলছে লকডাউন ৷ বন্ধ হয়ে রয়েছে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৷ আগামী 17 অগাস্ট স্কুল খোলার কথা থাকলেও পড়ুয়ারা তখনও আগের মতো ক্লাসে যেতে পারবে কিনা তা এখনও অজানা ৷ এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু-কিশোররা ৷ স্কুল বন্ধ থাকায় এককথায় এখন তারা গৃহবন্দী । এতে তাদের মনের উপরেও যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে ৷ তাদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন অভিভাবকরাও৷ তাঁরা চাইছেন, এই সমস্ত বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে হয় দ্রুত স্কুল খোলা হোক অথবা বাড়িতে গিয়ে তাদের মন ভালো রাখার জন্য সরকারি ব্যবস্থা করা হোক ৷ লকডাউন যে এই বাচ্চাদের কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা মেনে নিচ্ছেন শিক্ষকরাও ৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আপাতত কিছুই করার নেই বলে জানাচ্ছেন তাঁরা ৷ কবে এই বাচ্চারা ফের তাদের পুরোনো জীবনে ফিরে যেতে পারবে, তা এখনও অজানা ৷
মালদা জেলায় বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের জন্য কয়েকটি স্কুল রয়েছে ৷ শুধু শহরে নয়, এমন স্কুল রয়েছে গ্রামাঞ্চলেও ৷ প্রতিটি স্কুলই আবাসিক ৷ তবে শিশুদের মনের কথা মাথায় রেখে স্কুলের কাছাকাছি থাকা বাচ্চাদের বাড়ি থেকে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয় ৷ তেমনই একটি স্কুল রয়েছে ইংরেজবাজার ব্লকের কাজিগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের চণ্ডীপুর এলাকায় ৷ অধিকার রেসিডেন্সিয়াল স্কুল ফর দ্য মেন্টালি রিটার্ডেড নামে এই স্কুলটি রাজ্য সরকার প্রেষিত ৷ স্কুলে রয়েছে 80 জন মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন পড়ুয়া ৷ বেশিরভাগ পড়ুয়াই গ্রামাঞ্চলের ৷ তবে শহরেরও কয়েকটি শিশু এই স্কুলে পড়াশোনা করে ৷ ছেলেমেয়েদের পড়ানোর জন্য এই স্কুলে অভিভাবকদের কোনও টাকাপয়সা দিতে হয় না ৷ সরকারি অনুদান পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয় ৷ মালদা শহরের খ্যাতনামা চিকিৎসক, মানবেশ প্রামাণিকও এই স্কুলে অর্থ সাহায্য করে থাকেন ৷ এই স্কুলেই কয়েক বছর ধরে পড়াশোনা করছে এমনই এক মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন কিশোরী অংশিতা ৷ বাড়ি মালদা শহরের মকদুমপুর এলাকার দত্তপাড়ায় ৷ লকডাউন শুরুর পর থেকে বাড়িতেই রয়েছে সে ৷ তার বাবা অসিতবরণ দাস অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী ৷ অংশিতা তাঁর একমাত্র মেয়ে ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব বর্তেছে মা হিরাদেবীর উপর ৷ মেয়েকে নিয়ে অত্যন্ত সমস্যায় পড়েছেন তিনি ৷
লকডাউনে মানসিক সমস্যা বাড়ছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্নদের, দেখুন কী বলছেন অভিভাবকরা হিরাদেবী বলেন, “মেয়ে প্রতিদিন বাড়ি থেকেই স্কুল যেত ৷ সেটা তার অভ্যেস হয়ে গেছিল ৷ কিন্তু হঠাৎ করে তার সেই অভ্যেসে পরিবর্তন হয়েছে ৷ ও বুঝতে পারছে না, ওকে কেন আটকে রাখা হয়েছে ৷ সবসময় বাইরে যেতে চাইছে ৷ ওকে ঘরে কিছু করতে বললেই তার উত্তর, আমি ঘরে কিছু করব না ৷ আমি স্কুল যাব ৷ দিন দিন তার বায়না বেড়ে চলেছে ৷ এতে আমিও মাঝেমধ্যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি ৷ মেয়েকে ঠিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না ৷ বাড়িতে ও খুব বিরক্ত করা শুরু করেছে ৷ পড়াশোনা করছে না ৷ খাবার বেশি চাইছে ৷ ওর কথায় সায় না দিলেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে ৷ স্কুল ছিল ওদের ভয়, ভালোবাসার সঙ্গে আনন্দের জায়গা ৷ স্কুলের শিক্ষকদের ভয় পায় ৷ কিন্তু সেখানে ওর মতো আরও বাচ্চাদের সঙ্গ পায় বলে স্কুলে ওদের সময়টা খুব ভালো কাটে ৷ বাড়িতে এসব পাচ্ছে না ৷ ফলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না ৷ কিছু বললে আমাকে তো বটেই, বাবার উপরেও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে ৷ আমরাও এতে খুব সমস্যায় পড়ে গেছি ৷ তবে কি আমরা আবার পুরোনো জায়গাতেই ফিরে যাচ্ছি? স্কুলে দেওয়ার পরও অনেকটাই ভালো হয়ে উঠেছিল ৷ গান করত ৷ ছবি আঁকত ৷ যত দিন যাচ্ছে, তত ও এসব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ৷ এতে আমরাও মানসিক দিক থেকে ভেঙে পড়েছি ৷ আমরা চাই, এমন কিছু ব্যবস্থা হোক, যাতে বাড়িতে এসে কেউ কথা বলে ওদের মানসিক শান্তি দিতে পারে ৷”
অধিকার স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাশ্বত সাটিয়ার বলেন, “লকডাউন এই সব মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুদের মনের উপর অনেকটা প্রভাব ফেলেছে ৷ এই বাচ্চারা একটা সিস্টেমে তৈরি হচ্ছিল ৷ এদের অনেকে প্রতিদিন স্কুল গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফিরত ৷ অনেকে আবার হস্টেলে থাকত ৷ বাড়িতে থাকার অভ্যেস তাদের প্রায় চলে গেছিল ৷ কিন্তু লকডাউনে তাদের বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে ৷ এতে তাদের সঙ্গে অভিভাবকদেরও সমস্যা হচ্ছে ৷ কিন্তু এটাই এই বাচ্চাদের স্বাভাবিক আচরণ ৷ অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের কাজকর্মে বিরক্ত হচ্ছেন ৷ তাঁরা সেই বিরক্তি নিয়ে বাচ্চাদের শাসন করার চেষ্টা করছেন ৷ এতে বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে ৷ লকডাউন খুলে কবে স্কুল খোলা যাবে জানি না, কিন্তু স্কুল খোলার পর এই বাচ্চাদের পুরোনো অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের অনেক বেগ পেতে হবে ৷ কারণ, এসব বাচ্চারা কিছুদিন একটা সিস্টেমে থাকলে তাতেই পরিচিত হয়ে যায় ৷ পরবর্তীতে অন্য সিস্টেমে তাদের নিয়ে যাওয়া খুব সমস্যার ৷ মনে রাখতে হবে, এই বাচ্চারা মানসিকভাবে স্বাভাবিক নয় ৷ তাছাড়া দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকায় এরা পুরোনো সবকিছুই ভুলে যাবে ৷ ফলে স্কুল খোলার পর আমাদের আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে ৷ বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কীভাবে বেরোনো যাবে, তা আমরা কেউ জানি না ৷ এই বাচ্চাদের নিয়ে আপাতত অভিভাবকদেরই চিন্তাভাবনা করতে হবে ৷ স্কুল খুললে সেই চ্যালেঞ্জ আমরা নিয়ে নেব ৷ কারণ, আমরা এই চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত ৷ যত তাড়াতাড়ি স্কুল খুলবে, এই বাচ্চাদের জন্য তত ভালো হবে ৷ কিন্তু এটাও ঠিক, প্রাণের থেকে কিছু বড় নয় ৷”
পুরাতন মালদার মঙ্গলবাড়িতে রয়েছে দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েদের আরেক আবাসিক স্কুল, ড. পি আর রায় মেমোরিয়াল ব্লাইন্ড স্কুল ৷ এই স্কুলের পরিধি আরও বড় ৷ মালদা সহ মুর্শিদাবাদ ও দুই দিনাজপুর জেলা থেকে 70 জন দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়ে এখানে পড়াশোনা করে ৷ এখানেও বিনে পয়সায় দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েদের ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হয় ৷ লকডাউনের পর সরকারি নির্দেশ মেনে স্কুলের সব পড়ুয়াকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ কিন্তু বাড়িতে থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তারা ৷ তাই আজ বেশ কয়েকজন অভিভাবক স্কুলে এসে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, স্কুল যেন দ্রুত খোলা হয় ৷ যদিও কর্তৃপক্ষের পক্ষে সরকারি নির্দেশিকা অমান্য করে স্কুল খোলা সম্ভব নয় ৷ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা অভিভাবকদের সেকথা জানালেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েদের মানসিক বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁরাও ৷
এই স্কুলে পড়াশোনা করে মুচিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মোহনবাগান এলাকার বছর দশেকের তানিশা ৷ তার মা দুলালি বিশ্বাস বলেন, “আমার মেয়ে জন্ম থেকেই দেখতে পায় না ৷ তিন বছর ধরে এই স্কুলে পড়াশোনা শিখছে ৷ লকডাউনের পর থেকে মেয়ে বাড়িতেই রয়েছে ৷ আমি গৃহ পরিচারিকার কাজ করি ৷ বাড়িতে মেয়ে ঠিকমতো নিজের দৈনন্দিন কাজও করতে পারছে না ৷ স্কুল খোলা থাকলে আমাদের এসব নিয়ে ভাবতে হয় না ৷ সব কিছুই স্কুল কর্তৃপক্ষ করত ৷ স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে থাকলে ওর মনটাও ভালো থাকত ৷ বাড়িতে একা থেকে ওর জেদও বাড়ছে ৷ নোংরা নিয়ে খেলছে ৷ ফাঁকা পেলেই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে ৷ বাড়িতে ওকে শাসন করার মতো কেউ নেই ৷ আমি চাই, যত তাড়াতাড়ি হোক, স্কুল খুলুক ৷ তাতে আমার মেয়ের মতো বাচ্চাদের খুব সুবিধে হবে ৷ আমরাও সমস্যামুক্ত হব ৷” ইংরেজবাজারের বাগবাড়ি রাজনগর এলাকার আনসার শেখ এই স্কুলে এসেছিলেন ৷ তাঁর 9 বছরের নাতি রিজান শেখ এই স্কুলে তিন বছর ধরে পড়ছে ৷ লকডাউন শুরু হওয়ার পর সে বাড়িতেই থাকছে ৷ আনসার সাহেব বলেন, “আজ নাতির স্কুলে এসেছি ৷ নাতিটা বাড়িতে থেকে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ৷ এমনিতেই চোখে দেখতে পায় না ৷ কথাও ঠিকমতো বলতে পারে না ৷ এখন কথা বলা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে ৷ এখানে সবার সঙ্গে খেলাধুলো করত ৷ ওর মন ভালো থাকত ৷ আজ এসেছি কবে স্কুল খুলবে তা জানতে ৷ বাড়িতে থেকে ওর মানসিক সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে ৷ স্কুলে ওর অনেক উন্নতি হয়েছিল ৷ কিন্তু এতদিন বাড়িতে থেকে যা শিখেছিল, সব ভুলে গেছে ৷ ওর মাথায় আর কিছু নেই ৷”
এই স্কুলের শিক্ষিকা রেণুকা মান্না কাঞ্জিলাল বলেন, “এই স্কুলের পড়ুয়ারা সবাই আবাসিক ৷ লকডাউন ঘোষণার পর সরকারি নির্দেশ মেনে তাদের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ লকডাউন এই বাচ্চাদের উপর ভালোই প্রভাব ফেলেছে ৷ এই বাচ্চারা নিজেদের ইচ্ছেমতো বাইরে বেরোতে পারে না ৷ স্কুলে আমরা গান, আবৃত্তি সহ বিভিন্ন উপায়ে তাদের মনের খিদে মেটানোর চেষ্টা করি ৷ বাড়িতে তারা সেটা পাবে না ৷ বাড়িতে তারা মানসিক শূন্যতায় ভুগছে ৷ তাদের জেদ বাড়ছে, খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হচ্ছে ৷ এসব স্বাভাবিক ৷ আমরা ব্রেইল পদ্ধতিতে তাদের পড়াশোনা করাই ৷ বাড়িতে এই পদ্ধতিতে তাদের অভিভাবকরা পড়াশোনা করাতে পারবেন না ৷ তাই বাচ্চাদের শিক্ষা এখন শূন্য ৷ তারা এখন সবদিক থেকেই বঞ্চিত ৷ লকডাউন তুলে নেওয়ার পর স্কুল খুললেও বাচ্চারা পুরোনো কিছু মনে রাখতে পারবে না ৷ কারণ, নিয়মিত অভ্যেস ছাড়া ব্রেইল পদ্ধতি মনে রাখা যায় না ৷ হাতের গতি কমে যাবে ৷ আমাদের আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে ৷ একমাত্র স্কুল খুললেই ওদের এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনা যাবে ৷ অনলাইনে আমরা ওদের ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াতে পারব না ৷ এই বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমরাও এখন স্কুল খোলার সরকারি নির্দেশিকার দিকে তাকিয়ে রয়েছি ৷”