তিন দশক বিরোধীদের মনোনয়ন পড়ে না মোজমপুরে মালদা, 17 জুন:বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে'। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে লাইনটি বদলে হয়েছে 'গণতন্ত্রের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে...' । রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে সেরকমই এক পরিস্থিতি তৈরি হল একটি গ্রামের, যেখানে গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতা বদলালেও ভোটারদের পরিস্থিতি বদলায় না।
এক এক করে পেরিয়েছে 30 বছর ৷ বাম থেকে তৃণমূল, শাসকদল বদলালেও পরিস্থিতির বদল ঘটেনি ৷ গণতন্ত্র হরণের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ঘটনাস্থল কালিয়াচক 1 নম্বর ব্লকের মোজমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ৷ সেখানে শাসকদলেরই একচ্ছত্র অধিকার ৷ 30 বছর ধরে কোনও ভোটেই সেখানে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা পড়ে না ৷
শাসক বদলালেও এই ছবির বদল হয়নি এখনও ৷ এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও মনোনয়নের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে দেখা যায়, এই গ্রাম পঞ্চায়েতের 20টি আসনে তৃণমূল ছাড়া অন্য কোনও দলের মনোনয়ন জমা পড়েনি ৷ একই ছবি এই এলাকায় থাকা তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনেও ৷ তবে জেলা পরিষদ আসনে কংগ্রেস প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন ৷
বিষয়টি ভালো করে বুঝতে বছর ত্রিশেক পিছিয়ে যেতে হবে ৷ সেই সময় মোজমপুর মানেই মূর্তিমান আতঙ্ক ৷ প্রায় প্রতিদিনই বোমা-গুলির শব্দে ঘুম ভাঙত মানুষের ৷ সিপিএম-কংগ্রেসের এলাকা দখলের লড়াইয়ে প্রাণ গিয়েছে অনেকের ৷ একসময় সিপিএমের আসাহদুল্লা বিশ্বাস আর কংগ্রেসের তুহুর আলি বিশ্বাসের ক্ষমতায়নের লড়াই আজও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে ৷ তখন দৈনন্দিন কাজে প্রাণ হাতে করেই বেরোতে হত গ্রামবাসীদের ৷ পরে অবশ্য সেই পরিস্থিতি বদলে যায় ৷ এলাকা দখলের এই লড়াই এখন অনেক আধুনিক হয়েছে ৷ তার জন্য বোমা-গুলি চালানোর প্রয়োজন খুব একটা পড়ে না ৷ তবে কমেনি শাসকদলের রমরমা ৷
আরও পড়ুন:মনোনয়ন না তুললে বাড়ির মহিলাদের নিস্তার নেই, সিপিএম কর্মীদের হুমকি শাসক দলের
কালিয়াচকের বাসিন্দা তথা কংগ্রেসের জেলা মুখপাত্র রেজাউল হোসেনের দাবি, 1995 সাল থেকেই মোজমপুর এলাকায় তাঁরা প্রার্থী দিতে পারেন না ৷ এবারও 20টি গ্রাম পঞ্চায়েত আর তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বিরোধীদের কেউ প্রার্থী দিতে পারেনি ৷ বাম আমলে যে ছবি ছিল, তৃণমূলের জমানায় তার কোনও বদল হয়নি ৷ এই পঞ্চায়েত সংলগ্ন আলিপুর 2 নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীপুর গ্রামে ক’দিন আগে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা তাঁদের লোকজনের উপর হামলা চালায় বলে তিনি অভিযোগ করেন ৷
রেজাউল হোসেন বলেন, "আমরা যাতে সেখানেও মনোনয়ন জমা না দিতে পারি, তার জন্যই এই হামলা চালানো হয় ৷ এখনও দু'জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৷ তৃণমূলের দুষ্কৃতীর অভাব নেই ৷ ওরা মোজমপুর-সহ আশেপাশের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে যে প্রার্থী হওয়া অনেক দূরের কথা, কেউ প্রস্তাবকও হতে চাইছে না ৷ বিষয়টি বিডিওকে জানালে তিনি সাফ জানান, প্রস্তাবক দলেরই হতে হবে ৷ নইলে মনোনয়ন জমা দেওয়া যাবে না ৷"
আরও পড়ুন:বিরোধীদের ভয় দেখানোর নয়া উপায় ! জয়নগরে নির্দল প্রার্থীর বাড়িতে সাদা থান, মালা ও মিষ্টি
তাঁর প্রশ্ন, কিছুদিন আগে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলছিলেন ভোট শান্তিপূর্ণ হবে ৷ বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারবে ৷ সেটা হল কোথায়? তৃণমূলের আতঙ্কে কেউ প্রার্থী হতে চাইছে না বলে তাঁর দাবি ৷ তিনি বলেন, "মোজমপুরে আমাদের বেশ ভালো ভোট রয়েছে ৷ গত লোকসভা নির্বাচনে আমরা সেখানে 70-75 শতাংশ ভোট পেয়েছি ৷ আসলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত হল লুঠপাটের জায়গা ৷ এই জায়গা ওরা ছাড়তে রাজি নয় ৷ প্রশাসনের কাছে আমার আবেদন, যেসব জায়গায় বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি, সেখানে তাদের সেই সুযোগ করে দেওয়া হোক ৷ এবার শুনছি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হবে ৷ এতে আমরা খুশি ৷"
এটাই স্বাভাবিক ৷ বলছেন তৃণমূলের মোজমপুর অঞ্চল সভাপতি তারেক আলি বিশ্বাস ৷ তাঁর বক্তব্য, তাঁদের কাছে খবর আছে মোজমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের 20টি ও কালিয়াচক 1 নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির তিনটি আসনে তৃণমূল ছাড়া আর কেউ প্রার্থী দেয়নি ৷ এখানে কোনও সন্ত্রাস বা হুমকির বিষয় নেই ৷ এখানে যে কোনও ভোটে তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে, পাড়ায় পাড়ায় মানুষের সঙ্গে বসে একটাই প্রার্থী ঠিক করে ৷ আজ থেকে নয়, 30-35 বছর ধরে এভাবেই এখানে ভোট হয়ে আসছে ৷ এখানে সবাই একটাই জিনিস চায়, তা হল গ্রামের উন্নয়ন ৷ কেউ এসে দেখুক, প্রতিটি গ্রাম কেমন চকচক করছে ৷ মানুষ যেটা চাইছে, পেয়ে যাচ্ছে ৷ তাহলে বিকল্প রাখার প্রয়োজন কী? আর মনোনয়ন তো বিডিও অফিসে জমা পড়েছে ৷ এই এলাকায় তো পড়েনি ৷ কেউ মনোনয়ন জমা দিল না কেন? 2013 সাল থেকে তাঁরা তৃণমূলে রয়েছেন ৷ তিনটি পঞ্চায়েত নির্বাচন হল ৷ নির্বাচনের পুরোনো ধারা তাঁরা বজায় রেখেছেন ৷
আরও পড়ুন:তৃণমূল মনোনয়ন প্রত্যাহারে চাপ দিচ্ছে, হাওড়ায় অভিযোগ বিজেপি প্রার্থীর
যদিও সিপিএমের জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্রের দাবি, তাঁদের আমলে মোজমপুরে এমন সন্ত্রাসের ভোট ছিল না ৷ তিনি বলেন, "বাম জমানায় মোজমপুরে বিরোধীরাও প্রার্থী দিত ৷ ভোটে হয়তো আমরা জিততাম ৷ কাউকে মনোনয়ন জমা দেওয়া থেকে বিরত রাখা হত না ৷ কিন্তু এখন তৃণমূলের সন্ত্রাসে সেখানে বিরোধীদের হয়ে কেউ প্রার্থীই হতে চায় না ৷ আমাদের কাছে ভোটের থেকে বড় মানুষের নিরাপত্তা ৷ তাই সেখানে আমরা প্রার্থী দিইনি ৷ একটি গ্রাম পঞ্চায়েত কিংবা তিনটি পঞ্চায়েত সমিতির আসনে বিরোধীরা প্রার্থী না-দিতে পারলেও এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের পতন কেউ আটকাতে পারবে না ৷"