মালদা , 8 জুলাই : লকডাউন ৷ ছোটো শব্দ ৷ কিন্তু তার প্রভাব বহু বিস্তৃত ৷ বিশেষত বয়স্কদের কাছে লকডাউন যেন অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে ৷ গৃহবন্দী দশা যেন কেড়ে নিচ্ছে তাঁদের জীবনীশক্তি ৷ তিন মাস ধরে সমবয়স্ক , বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৷ স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রোজ সকাল কিংবা বিকেলে পার্ক কিংবা খোলা মাঠে তাঁরা একসঙ্গে মিলিত হতেন ৷ নিজেদের মনের কথা একে অপরকে বলতেন । আলোচনা করতেন ৷ মনের গুমোট ভাব কিছুটা হলেও হালকা হয়ে যেত ৷ কিন্তু কোরোনা আতঙ্ক কেড়ে নিয়েছে সবকিছু ৷
প্রতিদিন সকাল কিংবা বিকেল হলে বাড়ি থেকে একদল বৃদ্ধ বেরিয়ে পড়তেন । মালদা শহরের বৃন্দাবনি ময়দান, কলেজ মাঠ কিংবা এয়ারপোর্ট , এই তিন জায়গাতেই মূলত তাঁরা জড়ো হতেন ৷ একই সঙ্গে চলত শরীরচর্চা আর বন্ধু কিংবা সমবয়সিদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের আলোচনা ৷ তবে বিকেল থেকে সকালেই সেই দৃশ্য বেশি চোখে পড়ত ৷ গত তিন মাস ধরে সেই ছবি আর ধরা পড়ে না ৷ দেশে কোরোনার প্রকোপ শুরু হতেই বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দিয়েছেন, কোরোনায় সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বয়স্কদের ৷ কোরোনায় সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুর হারও তাঁদের বেশি ৷ ফলে ঘর থেকে বেরোনোই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন তাঁরা ৷
কোরোনা , লকডাউন , গৃহবন্দী দশা , সব মিলিয়ে মানসিক সমস্যায় জেরবার বয়স্করা ৷ সেকথা শোনা গেল শহরের এয়ারভিউ কমপ্লেক্সের বাসিন্দা মৃদুলকান্তি সরকারের মুখে ৷ বয়স 70 পেরিয়েছে ৷ দীর্ঘদিন ধরে ব্লাড সুগার ও প্যাংক্রিয়াসের সমস্যায় ভুগছেন ৷ কোরোনা সংক্রমণের জেরে লকডাউন লাগু হওয়ার পর আতঙ্কে আর ঘর থেকে বেরোননি ৷ তিনি বলেন, “প্রায় তিন মাস ধরে লকডাউন আমার কাছে প্রকৃতই গৃহে অজ্ঞাতবাস ৷ আমি APDR-এর সঙ্গে জড়িত ৷ সংগঠনের মাধ্যমে আমরা অনেক সমবয়সি একসঙ্গে ওঠাবসা করতাম ৷ শরীরের দিকে নজর দিয়ে বিকেলে বৃন্দাবনি ময়দান কিংবা বাঁধ রোডে হাঁটতাম ৷ এখন আনলক পর্ব চললেও সেসব বন্ধ রয়েছে ৷ লকডাউনের প্রথম পর্ব থেকে সেই অভ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে ৷ এখন আমরা ঘরে থেকে থেকে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি ৷ এখন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যেটুকু যোগাযোগ তা ফোনের মাধ্যমে ৷ ঘরে থেকে নতুন কিছু বদভ্যাসও তৈরি হয়েছে ৷ টেলিভিশন দেখার নেশা বেড়েছে ৷ কিন্তু এভাবে থাকতে থাকতে মাঝেমধ্যেই মানসিক অবসাদ প্রকট হয়ে উঠছে ৷ এই পরিস্থিতিতে কী করব, কার সঙ্গে মিশব , তা নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন উঠছে ৷ কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তখন আগের পরিবেশ ফিরে পাব কি না , তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে ৷”
মানসিক অবসাদে বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায় একই বক্তব্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রদীপকুমার নাথের ৷ লকডাউনের প্রথমদিকে বাড়ি থেকে বেরোননি ৷ কিন্তু দিনের পর দিন ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন তিনি ৷ তাই কয়েকদিন আগে থেকে রোজ সকালে বাড়ির পাশে কলেজ মাঠে চলে আসছেন ৷ পুরানো অভ্যাস মতো বেশ কিছুক্ষণ গা ঘামিয়ে বাড়ি ফিরছেন ৷ যদিও তাঁর বন্ধুরা কেউ মাঠে আসেন না ৷ প্রদীপবাবু বলেন , “যত দিন যাচ্ছে কোরোনার আতঙ্ক মানুষকে তত বেশি গ্রাস করছে ৷ আমাদের মতো বয়স্ক লোকজনও চাইছে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে সরকারি নির্দেশ মেনে ঘরের মধ্যেই থাকা ভালো । কিন্তু এভাবে কতদিন ? এভাবে থাকতে থাকতে আমাদের মনের উপর অসম্ভব চাপ পড়ছে ৷ বাড়ির মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় থাকতে থাকতে মন খারাপে ভুগছে প্রায় সবাই ৷ এতে পারিবারিক ঝামেলাও বাড়ছে ৷ মানসিক অশান্তি কিংবা অস্বস্তি, দুটোই বাড়ছে ৷ আমি মনে করি, বাড়িতে থাকা এবং বাড়ির বাইরে বেরোনো , দুটোরই প্রয়োজন আছে ৷ তবে বাইরে বের হলে আমাদের শারীরিক দূরত্ববিধি মেনে চলতেই হবে ৷ মুখ্যমন্ত্রীও এই বিধি মেনে সবাইকে প্রাতঃভ্রমণে বের হতে বলেছেন ৷ পরিস্থিতি যখন ঠিক ছিল তখন প্রতিদিন সন্ধেয় আমরা কয়েকজন বন্ধু একসঙ্গে আড্ডা মারতাম ৷ সুখ-দুঃখের আলোচনা করতাম ৷ এখন সেই আড্ডা পুরোপুরি বন্ধ ৷ শুধুমাত্র ফোনে যোগাযোগ ৷ লকডাউন শিথিল হওয়ার পর মাত্র একদিন আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে সবাই সবাইকে দেখেছিলাম ৷ কিন্তু সেদিনও দেখেছি পরিবেশ যেন অনেক পালটে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে ৷ ”
একাকিত্ম কবি কিংবা সাহিত্যিকদের মনের দরজা খুলে দেয় ৷ মানুষ নতুন নতুন লেখা হাতে পায় ৷ আমবাঙালি সেটাই জেনে এসেছে ৷ কিন্তু এই পরিস্থিতি তাঁদেরও যেন খানিকটা আনমনা করে তুলেছে ৷ তেমনটাই উঠে এসেছে সাহিত্যিক তৃপ্তি সান্ত্রার গলায় ৷ তিনি বলেন , “তিন মাসের লকডাউনে আমি কীভাবে আছি সেটা বড় কথা নয় ৷ বাস্তবটা হল এই পরিস্থিতিতে কোনও মানুষই ভালো নেই ৷ আমরা যারা শহুরে মানুষ তারা একভাবে রয়েছি ৷ আর যারা বস্তি কিংবা মাঠেঘাটে রয়েছে তাদের অবস্থা আরও অবর্ণনীয় ৷ আমরা যারা ঘরে থাকছি তারা কিন্তু বাধ্যতামূলক আটকে রয়েছি ৷ অনেকের সকালে-বিকেলে ঘোরাঘুরির অভ্যাস থাকে ৷ বাজারে যাওয়ার অভ্যাস থাকে ৷ শুধু পুরুষ নয় অনেক মহিলারও সেই অভ্যাস রয়েছে ৷ সেসব বন্ধ হয়ে গেছে ৷ মানুষ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারছে না ৷ বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া রয়েছে বটে , কিন্তু সবাই সেসব ব্যবহার করতে পারেন না ৷ অনেকে সড়গড় নন ৷ এখন আমরা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেও দেখা করতে পারছি না ৷ তাদের বাড়ি যেতে পারছি না ৷ বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মাকে নিয়ে অনেক ছেলেমেয়ে থাকেন ৷ তাঁরাই বা বাবা-মায়ের কতটা যত্ন নেবেন ? তাঁদেরও তো দৈনন্দিন কাজকর্ম রয়েছে ৷ বড় বাড়ি হলে কিংবা বাড়িতে অনেক জায়গা থাকলে বয়স্কদের একাকিত্মের ভাবনা অনেকটা কেটে যায় ৷ কিন্তু শহরের ফ্ল্যাটবন্দী জীবনে সেই জায়গা কোথায় ? ছোটো ঘরে অনেকগুলি মানুষকে গাদাগাদি করে মৃত্যুর আতঙ্ককে সঙ্গী করে দিন কাটাতে হচ্ছে ৷ এটা কল্পনাতীত ৷ আমরা সত্যিই খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি ৷ বয়স্করা ভয়ঙ্কর মৃত্যু ভয়ে ভুগছেন ৷ এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ কাছে আসবে না ৷ মারা গেলে সৎকার্য করার লোক পাওয়া যাবে না ৷ এসব মানুষকে ভাবাচ্ছে ৷”
লকডাউনে বয়স্কদের মানসিক সমস্যা নিয়ে ভাবার জন্য ETV ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বঙ্গরত্ন শক্তি পাত্র ৷ সত্তরোর্ধ শক্তিবাবু বলেন, “ আমাদের মতো বয়সে সাধারণত মানুষের যোগাযোগ কমে যায় ৷ এমনকী এই বয়সের মানুষ নিজের বাড়িতেই অপাংতেয় হয়ে যান ৷ কারণ, বাড়ির পরবর্তী প্রজন্ম এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চায় না বলে তাঁদের এড়িয়ে যায় ৷ তিনি সেসব বুঝতে পারেন ৷ তাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে সমবয়সিদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে তিনি সেই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান ৷ এই সময় অনেকে ধর্মালোচনাতেও অংশ নেন ৷ কিন্তু লকডাউনে আলোচনা , গল্পগুজব বন্ধ হয়ে গিয়েছে ৷ প্রশ্ন উঠতে পারে , তার জন্য তো ফোন রয়েছে ? ইংরেজিতে একটি কথা রয়েছে , rubbing shoulders with others ৷ একে অন্যের সঙ্গে কাঁধ ঘষাঘষি করে বাঁচা ৷ তার অর্থ , মানুষ কাছাকাছি থেকে বাঁচতে চায় ৷ কিন্তু কোরোনা আবহে প্রতিবেশী এখন কাছের লোক নয় ৷ এখন গ্রামের মানুষও অনেকটা শহরের মতো হয়ে গিয়েছে ৷ এখন একটা স্লোগান শোনা যাচ্ছে , আপনি ঘরে , কোরোনা দূরে ৷ ঘরে সবাই একসঙ্গে থাকলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মানসিক সমস্যা মিটতে পারে ৷ কিন্তু এখন বেশিরভাগ বাড়িতেই মনে করা হয় , বয়স্করা এমন আলাপ আলোচনার যোগ্য নন ৷ কারণ, তাঁর ধ্যানধারণা এই যুগে চলে না ৷ তাঁরা হয়তো 15 দিন লকডাউন মেনে চলতে পারেন ৷ কিন্তু যখন সেটা তিন মাস হয়ে যায় , তখন তিনি মানসিক অবসাদের শিকার হবেন ৷ একটা মনস্তাত্বিক থিওরি রয়েছে, cognate behavioral therapy ৷ অর্থাৎ নিজের মনের কথা বিশ্বাসযোগ্য কাউকে খুলে বলে অবসাদ থেকে বেরোনোর উপায় ৷ আমরা থ্রি ইডিয়টস্ সিনেমাতেও সেটা দেখেছি ৷ সেখানে লোবো নামে একটি ছেলে মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করেছে ৷ কিন্তু ফারহান কিংবা তার এক বন্ধু ব়্যাঞ্চোর সান্নিধ্যে জীবনের অর্থ বুঝতে পেরেছে ৷ আমাদের মতো বয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে ৷ আমরাও নিজেদের যন্ত্রণার কথা একে অন্যকে খুলে বলে হালকা হতে পারি ৷ এটা আমাদের আয়ু বাড়িয়ে দেয় ৷ লকডাউনে সব স্তরের মানুষই মানসিক অবসাদে ভুগছে ৷ প্রচুর মানুষ কোরোনা সংক্রমিত না হলেও অবসাদগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে যাবে ৷ এই অবস্থা থেকে বয়স্কদের বাঁচানোর জন্য উপায় বের করতে হবে ৷ যেভাবে নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থা খুঁজে বের করা হয়েছে ৷ এখন একটা ভাবনা এসেছে , কোরোনার সঙ্গে এই সব বয়স্করাও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাক ৷ একটা বিশেষ বয়সের পর কারও বেঁচে থাকার অধিকার নেই ৷ এই ভাবনা মানুষের মন থেকে দূর করা প্রয়োজন ৷ ETV ভারতের মনে যে এই মানুষদের মন নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে , তার জন্য ধন্যবাদ ৷”
মানসিক অবসাদে ভুগছেন বয়স্করা