মালদা, 21 অগস্ট: মালদার হবিবপুর ব্লকের শ্রীরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের শিরষি গ্রাম ৷ গ্রামের ধারে ইন্দো-বাংলা সীমান্তের কাঁটাতার ৷ শহর থেকে দূরত্ব 40 কিলোমিটার দূরের এই গ্রামেই জন্ম 27 বছরের তারাশংকর রায়ের ৷ তাঁর বাবা ঊমাশংকরবাবু পেশায় ফার্মাসিস্ট ৷ এখন অবশ্য চাষবাসেই বেশি মন দিয়েছেন ৷ আর মা প্রতিমা রায় আইসিডিএস কর্মী ৷ এহেন এই গ্রাম্য যুবক তারাশংকর এখন মানবসেবায় মালদা জেলার আইকন ৷ তাঁর কাজ ভবঘুরেদের বাড়ি ফেরানো ৷ কলেজ জীবনে শুরু করেছিলেন ৷ এখনও পর্যন্ত 192 জন ভবঘুরেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁদের পরিবারে ৷ তাঁর এই কাজকে স্যালুট জানিয়েছেন খোদ মালদা জেলার পুলিশ সুপার ৷ তারাশংকরের অবদান কি ভুলতে পারেন হারিয়ে যাওয়া ঘরের লোককে ফিরে পাওয়া মানুষজন !
স্নাতক তারাশংকর আর চাকরি খোঁজেন না ৷ পারিবারিক কৃষিজমিতেই নিজের ভবিষ্যৎ খুঁজে নিয়েছেন ৷ চাকরি যে তাঁর মানবসেবায় সময়ের বাধা হতে পারে ! তিনি বলছেন, “ভবঘুরেদের মানুষ অন্য চোখে দেখে ৷ ওরা রাস্তায় পড়ে থাকে ৷ কলকাতায় আশুতোষ কলেজে পড়তাম ৷ কলেজ থেকে মেসে যাতায়াতের পথে এমন অনেক মানুষকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখতাম ৷ তাঁদের পোশাক নেই, পেটে খাবার নেই ৷ অনেকের তো মাথায়, পায়ে পোকা বাসা বেঁধেছে ৷ ওদের দেখে খুব কষ্ট হত ৷ তখনই মাথায় আসে, এদের সেবা করে, সুস্থ করে বাড়ি ফেরাতে হবে ৷ সেই শুরু, 2016 সাল থেকে এখনও পর্যন্ত আমার এই সেবা চলছে ৷”
তারাশংকর বলেন, “এখনও পর্যন্ত গোটা দেশের 192 জন ভবঘুরেকে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়েছি ৷ সবসময় পুলিশ বা প্রশাসনের সহযোগিতা পাই না ৷ তবে, বেশিরভাগ সময় সেই সহায়তা পাই ৷ কোনও ভবঘুরেকে রাস্তায় দেখতে পেলে প্রথমে, তাঁর কাছে গিয়ে ভালোবাসার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করি ৷ বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি ৷ স্নান করিয়ে, নতুন পোশাক পরিয়ে, খাবার খাইয়ে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, সে এই পরিবারেরই একজন ৷ এর পর কথাবার্তা বলে তাঁর বাড়ির কোনও সূত্র পাওয়ার চেষ্টা করি ৷ সেই সূত্র মিললেই গুগল ম্যাপে সেই জায়গার সন্ধান চালাই ৷ সেখানকার স্থানীয় লোকজন, পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করি ৷ এই কাজে অসুস্থ বাবা-মা যেভাবে পাশে দাঁড়ান, তা বলার নয় ৷ তাঁরাই ভবঘুরেদের সন্তান স্নেহে আসল পরিচর্যা করেন ৷”
মানবসেবক তারাশংকরকে এখন একডাকে চেনে জেলাবাসী ৷ তাঁর সেই জনপ্রিয়তা এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে কাজে লাগিয়েছে বিজেপি ৷ জেলা পরিষদের আসনে প্রার্থী হয়ে জয়ও পেয়েছেন তিনি ৷ কেন রাজনীতিতে ? তাঁর উত্তর, “রাজনীতিতে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না ৷ শুধু অবহেলিত আর অপমানিত মানুষজনের জন্য এই রাস্তায় নেমেছি ৷ এই এলাকার 90 শতাংশ মানুষ আদিবাসী ৷ তাঁদের অধিকাংশ প্রশাসনিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত ৷ সামান্য একটি ত্রিপলের জন্য তাঁদের বিডিও অফিসের সামনে পড়ে থাকতে হয় ৷ বিডিও-র ঘাড়ধাক্কা খেয়ে তাঁদের বাড়ি ফিরে আসতে হয় ৷ এর থেকে কষ্টের আর কী হতে পারে !’’
তাঁর মতে, ‘‘আমার মনে হয়েছিল, রাজনীতিতে এসে এই মানুষগুলোর অধিকারের জন্য লড়াই করা যেতে পারে ৷ তার জন্যই এই পথে এসেছি ৷ আপাতত নিজেদের জমানো অর্থেই ভবঘুরেদের সেবা করি ৷ এতে বন্ধুরাও আমাকে খুব সাহায্য করে ৷ সামাজিক মাধ্যমেও সাহায্য পাই ৷ এই কাজ করে মানুষের ভালোবাসা পাই ৷ এর থেকে আর বেশি পাওয়ার কী আছে ! সবাইকে বলব, আজ আছি, কাল নেই ৷ কিন্তু, আমাদের প্রত্যেকের সমাজের জন্য কিছু দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন ৷ এতে সমাজও তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিছু দিয়ে যেতে পারবে ৷”
আরও পড়ুন:বরাবরের ফার্স্ট-বয় সৎপালের নেশা ছিল বাগান পরিচর্যা ও সমাজসেবা