মালদা, 22 ফেব্রুয়ারি : দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বাবার ৷ ভেঙে পড়েছে একমাত্র ছেলে ৷ কিন্তু প্রয়াত বাবার স্বপ্নপূরণ করার ভার যে তার কাঁধেই ৷ তাই সেই শোক দূরে সরিয়েই মাধ্যমিক পরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ৷ পাশে দাঁড়িয়েছে জেলা প্রশাসন ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদও ৷ পরীক্ষা চালিয়ে যেতে সবরকম সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ গতকাল সকালে ওই পরীক্ষার্থীর বাড়িতে যান জেলা প্রশাসন ও পর্ষদের প্রতিনিধিরা ৷ তাকে সাহস জোগানোর পাশাপাশি সবরকম সাহায্য করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ৷
পরীক্ষার্থীর নাম অজয় সরেন৷ বাড়ি পুরাতন মালদার ভাবুক গ্রাম পঞ্চায়েতের আদিবাসী অধ্যুষিত সায়েদপুর গ্রামে৷ বাবা লোলিন সরেন (40) ছিলেন কৃষক৷ অজয়রা তিন ভাই-বোন ৷ বড় দিদির বিয়ে হয়ে গেছে ৷ ছোটো দিদি এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে ৷ অজয় স্থানীয় রাম মার্ডি হাইস্কুলের ছাত্র ৷ পড়াশোনাতেও বেশ ভালো সে ৷ ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ছাড়েননি লোলিনবাবু ৷ তিন ছেলেমেয়েকেই পড়াশোনা করিয়েছেন ৷ স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে অজয় সরকারি চাকরি করবে ৷ কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল ৷ ছেলের স্বপ্নপূরণের লড়াই দেখে যেতে পারলেন না তিনি ৷
অজয়ের পরীক্ষার সিট পড়েছে পুরাতন মালদারই সাহাপুর হাইস্কুলে ৷ লোলিনবাবু মোটরবাইক করে ছেলেকে সেখানে নিয়ে যাওয়া-আসা করতেন ৷ আগের পরীক্ষাগুলোর মতোই বৃহস্পতিবারও ভূগোল পরীক্ষার পর তিনি ছেলেকে মোটরবাইকে চাপিয়ে 34 নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বাড়ি ফিরছিলেন৷ কিন্তু নারায়ণপুরের কাছে ঘটে যায় দুর্ঘটনা ৷ উলটোদিক থেকে তীব্রগতিতে আসা একটি ছোটো লরি তাঁর মোটরবাইকে সজোরে ধাক্কা মারে ৷ দুর্ঘটনায় বাইক থেকে ছিটকে পড়েন লোলিনবাবু ৷ পড়ে যায় অজয়ও ৷ স্থানীয়রা সঙ্গে সঙ্গে দু'জনকে মালদা মেডিকেলে নিয়ে যান ৷ চিকিৎসকরা তখনই জানিয়ে দেন, লোলিনবাবুর অবস্থা আশঙ্কাজনক ৷ হাত ভেঙে গেছে অজয়েরও ৷ পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসকরা অজয়ের চিকিৎসা করে তাকে ছেড়ে দেন ৷ ভরতি করে নেওয়া হয় লোলিনবাবুকে ৷ রাতে মারা যান তিনি ৷
বাবাকে হারিয়েও পরীক্ষা দিতে অনড় অজয় আচমকাই এই দুর্ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে অজয়ের বাড়িতে ৷ স্বামীকে হারিয়ে মাঝে মধ্যেই জ্ঞান হারাচ্ছেন মারাংময়ী হাঁসদা ৷ কেউই কথা বলার অবস্থায় নেই ৷ এরই মধ্যে গতকাল সকালে অজয়ের বাড়িতে যান জেলা প্রশাসনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অভিষেক চক্রবর্তী ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন মাধ্যমিক পর্ষদ নিযুক্ত মালদা জেলার মাধ্যমিক পরীক্ষার আহ্বায়ক বিপ্লব গুপ্ত, উত্তর মালদা মহকুমা আহ্বায়ক গোপালচন্দ্র দাস ও ভাবুক রাম মার্ডি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ৷ অজয় তাঁদের জানায় , বাবার মৃত্যু শোক ভুলে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে চায় ৷ স্বপ্ন পূরণ করতে চায় বাবার ৷ কিন্তু হাত ভেঙে যাওয়ায় তার পক্ষে লেখা সম্ভব নয় ৷ সঙ্গে সঙ্গে তার অনুলেখকের ব্যবস্থা করা হয় ৷ তার স্কুলেরই নবম শ্রেণির ছাত্র সঞ্জিত টুডু আগামীকাল থেকে তার অনুলেখকের কাজ করবে ৷ এছাড়াও আগামীকাল থেকে প্রশাসনের গাড়ি অজয়কে বাড়ি থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া-আসা করবে বলে জানিয়ে দেন তাঁরা ৷
গ্রামের এক বাসিন্দা রবি সরকার বলেন, "গতকাল দুর্ঘটনায় অজয়ের বাবা লোলিন হাঁসদা মারা যান৷ আজ সকালে প্রশাসনিক কর্তারা অজয়ের বাড়িতে আসেন৷ অজয় যাতে বাকি পরীক্ষাগুলি ঠিকভাবে দিতে পারে তার ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন৷ তার জন্য অনুলেখকের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি ৷" এদিকে জেলা প্রশাসনের OC (এডুকেশন) অভিষেক চক্রবর্তী বলেন, "গতকাল একটি মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় এক মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর বাবার মৃত্যু হয়েছে৷ গুরুতর আহত হয়েছে ওই পরীক্ষার্থীও ৷ এই ঘটনায় সে শারীরিক ও মানসিক আঘাত পেয়েছে ৷ তাকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই ৷ আগামীকাল মাধ্যমিকের পরীক্ষা রয়েছে ৷ আজ আমরা প্রশাসন ও পর্ষদের পক্ষ থেকে তার বাড়িতে এসেছি ৷ তার জন্য পর্ষদের পক্ষ থেকে অনুলেখকের ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ অজয়কে সবরকম সাহায্যের জন্য আমরা প্রস্তুত ৷"