মালদা, 7 জানুয়ারি : একসময় মঞ্চ কাঁপাতেন তিনি। 'নন্দী' চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখে হেসে লুটোপুটি খেতেন দর্শকরা। আজ সেই শিল্পীর পেট চলে শুধুমাত্র পুরনো এক সেলাই মেশিন চালিয়ে। বয়স 75 পেরিয়ে গেলেও তাঁর কপালে কোনও সাহায্য জোটেনি। গম্ভীরার মঞ্চে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন লোকশিল্পী মহম্মদ হাফিজ (Gambhira Artist)। লোকসংস্কৃতির গবেষকদের মতে 'গম্ভীরা' শব্দটির উৎস 'গম্ভীর’ অর্থাৎ শিব। গম্ভীরা প্রকৃত অর্থে শিবের উপাসনা।
মালদা জেলার বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক সুস্মিতা সোম তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, মালদা ও দিনাজপুর এলাকা একসময় পৌন্ড্রবর্ধনভুক্ত ছিল। এই পৌন্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন জনগোষ্ঠী হল পৌন্ড্রিক, পৌন্ড্র, পৌন্ড্র-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি। এই জেলার পুরাতন মালদা, গাজোল, বামনগোলা এবং হবিবপুর বরেন্দ্রভূমি বা বরিন্দ হিসেবে পরিচিত। এই এলাকায় রাজবংশী, দেশিপলি, সাধুপরি প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বাস। কোচ, পৌন্ড্র প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই সমস্ত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উৎসবই 'গম্ভীরা’। এই উৎসবের দুটি দিক। একটি আচারগত, অন্যটি ব্যবহারিক। গম্ভীরার আচারগত দিকটি অতি প্রাচীন। বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম এই শাখার অস্তিত্ব শিব পুরাণেও পাওয়া যায়। তুলনায় ব্যবহারিক দিকটি অনেক নবীন। বর্তমানে যে 'গম্ভীরা' মানুষের সামনে প্রদর্শিত হচ্ছে তার উৎপত্তি 500 বছরের কিছু বেশি সময় আগে। এই গানের আসরে শিব একটি বড় ভূমিকা পালন করে। তিনি সমাজে শীর্ষ অবস্থানের প্রতীক। গম্ভীরা গায়ক এবং অভিনেতারা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নানাবিধ সিদ্ধান্ত মঞ্চে শিবের সামনে তুলে ধরেন।
চরম আর্থিক দুরবস্থায় দিন কাটছে মালদার গম্ভীরা শিল্পী মহম্মদ হাফিজের 30 বছর আগে গম্ভীরার মঞ্চে শিবের চ্যালা নন্দীর চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতেন মালদা শহরের মীরচক এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ হাফিজ। তাঁর সময়কালের কোনও 'গম্ভীরা' শিল্পীই আজ আর বেঁচে নেই। হাফিজ সাহেবের শরীরেও থাবা বসিয়েছে বয়স। নিজের ছোট্ট বাড়িটাতে পুরনো একটি সেলাই মেশিন চালিয়ে কোনওরকমে পেট চালান। ঘরে রয়েছেন অসুস্থ স্ত্রী। তিন ছেলে এক বাড়িতে থাকলেও তাদের নিজেদের সংসার রয়েছে। আর্থিক সংকটে তাঁরাও বাবা-মাকে খুব একটা সাহায্য করতে পারে না।
আরও পড়ুন:একসঙ্গে করোনা আক্রান্ত ৩১ জন কর্মী, প্রায় অচলাবস্থা মালদা জেলা পরিষদে
ইটিভি ভারতকে হাফিজ সাহেব বলেন, " গোপীনাথ শেঠ বেঁচে থাকাকালীনই আমি গম্ভীরা শিল্পে প্রবেশ করি। 25-30 বছর গম্ভীরার মঞ্চে নন্দীর চরিত্রে অভিনয় করেছি। বছর পাঁচেক আগে অভিনয় ছেড়ে দিই। অভিনয় করে খুব ভাল লাগত। মুসলমান বলে আমি গম্ভীরা শিল্প থেকে সরে আসিনি। শিল্পে আমি হিন্দু-মুসলমান বুঝি না। আমি মানুষ। যে কোনও উৎসব মানুষের। এখনও এই শিল্প হারিয়ে যায়নি। একটু ঘষামাজা করলে ফের এই শিল্প রমরমিয়ে চলবে। আমার অভিনয় দেখে লোকজন খুব হাসত। খুব ভাল লাগত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গম্ভীরার মঞ্চে অভিনয় করেছি। " হাফিজ সাহেবের প্রতিবেশী নুরুল ইসলামের গলাতেও আক্ষেপ শোনা গেল। নুরুল ইসলাম বলেন, " হাফিজ সাহেবের সম্পর্কে আমি সবই জানি। মটরাদা, নীরুদার আমল থেকেই হাফিজ সাহেব গম্ভীরা শিল্পে জড়িত। দেশের বিভিন্ন প্রদেশে তিনি গম্ভীরা গানে নন্দী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু এখন জেলার প্রাচীন এই লোকসংস্কৃতি প্রায় ধ্বংসের মুখে। "