মালদা, 9 জুন: প্রায় তিনমাস ধরে চলছে লকডাউন ৷ কর্মহীন বহু মানুষ ৷ আবার পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে ৷ অনেকে আবার কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন ৷ কারও যেন মানসিক স্থিতি নেই ৷ এই অবস্থায় সমস্যায় শিশুরাও ৷ কোরোনা মোকাবিলায় রাজ্যের সমস্ত স্কুল বন্ধ ৷ অন্যদিকে বন্ধ রয়েছে পার্ক, খেলার মাঠ ৷ ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে তাদের বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না ৷ ভয়টা যেন তাদের মনেও গেঁথে গিয়েছে ৷ বড়দের মুখে বারবার কোরোনা আতঙ্কের কথা শুনে অনেক শিশুই চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেদের স্বেচ্ছাবন্দী করে ফেলেছে ৷ এমন পরিস্থিতি বেশিদিন চললে শিশুরা মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে বলে মনে করছেন মনোবিদরা ৷ কোরোনা আবহে কীভাবে শিশুমনকে ঠিক রাখা যাবে, তাও জানালেন তাঁরা ৷
শহরের এক বেসরকারি স্কুলে সিনিয়র KG বিভাগে পড়ে পাঁচ বছরের সৌহার্দ্য ৷ লকডাউনের পর থেকে বাড়ির বাইরে বেরোয়নি সে ৷ তার কথায়, "অনেকদিন ধরে বাড়িতে আছি ৷ স্কুল হচ্ছে না ৷ কোরোনার জন্য স্কুল বন্ধ ৷ পার্কে গেলেও কোরোনা হবে ৷ বাড়িতেই পড়ছি, খেলছি ৷ মোবাইল গেম ৷ পার্কে যেতে ইচ্ছে করছে না ৷ কোরোনা হয়ে যাবে ৷"
দ্বিতীয় শ্রেণির কণিষ্কা রায় ৷ লকডাউন মরশুমে বই, কমপিউটার আর টেলিভিশনই এখন তার সব ৷ সে বলে, "একদম ভালো লাগছে না ৷ কোরোনার জন্য স্কুল যেতে পারছি না ৷ পার্ক কিংবা মাঠে খেলতে যেতে পারছি না ৷ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে না ৷ এভাবে আর ভালো লাগছে না ৷ স্কুল, পার্কে যেতে খুব ইচ্ছে করছে ৷"
লকডাউন যে সন্তানদের মানসিক বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তা মেনে নিচ্ছেন মায়েরা ৷ তবু, তাঁরা চান না এখনই স্কুল খুলুক ৷ লকডাউন শিথিল হলেও এখনই মাঠ কিংবা পার্ক খোলা হোক তাও চাইছেন না তাঁরা ৷
সৌহার্দ্যর মা সীমা সাহা বলেন, "আমার ছেলের মনে কোরোনার প্রভাব অনেকটাই পড়েছে ৷ এমনকি ওর মনে একটা ভীতিও দেখা দিয়েছে ৷ কেউ যদি ওকে তার বাড়িতে ডাকে, ও সাফ জানিয়ে দিচ্ছে, বাড়ির বাইরে বেরোলে আমার কোরোনা হয়ে যাবে ৷ নইলে বলছে, এখন বাড়ির বাইরে গেলে পুলিশ বকা দেবে ৷ ভয়ে বাড়ি বেরোতে চাইছে না ৷ লকডাউনে ছেলের খানিকটা জেদ বেড়েছে ৷ মাঝেমধ্যে হয়তো সব ভুলে যায় ৷ কিন্তু ওরা স্কুলের শিক্ষিকা, বন্ধুদের মিস করে ৷ তবে এই মুহূর্তে আমরা স্কুল খোলার কথা ভাবতেই পারছি না ৷ একই কথা পার্ক কিংবা খেলার মাঠের ক্ষেত্রেও সত্যি ৷ এসব জায়গায় আমরা বাচ্চাদের কতটা সুরক্ষিত রাখতে পারব বুঝতে পারছি না ৷ কোরোনা মোকাবিলায় ওষুধ কিংবা ভ্যাকসিন বেরোনোর পরেই এসব খোলা উচিত৷"
প্রায় একই বক্তব্য কণিষ্কার মা রূপশ্রী রায়ের ৷ তিনি বলেন, "ওরা বাড়িতে থাকছে সেটা ঠিক ৷ কিন্তু, স্কুল যেতে পারলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হত ৷ সবাই মিলে একসঙ্গে পড়লে পড়াশোনাও ভালো হত ৷ সেটা বাড়িতে সম্ভব নয় ৷ বাড়িতে পড়া হলেও তার মাধ্যম মোবাইল ফোন ৷ এতে বাচ্চাদের মোবাইল প্রীতি নিশ্চিতভাবে বাড়ছে ৷ সেটা মোটেও ভালো হচ্ছে না ৷ এছাড়া অন্য উপায়ও নেই ৷ মেয়েকে দেখে মাঝেমধ্যেই মনে হচ্ছে, ও ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছে৷ সঙ্গী না পেলে এটাই হয় ৷ মা-বাবা আর কতক্ষণ বাচ্চাদের সঙ্গ দিতে পারে ! তবে কোরোনার ভ্যাকসিন না বেরোনো পর্যন্ত স্কুল, পার্ক কিংবা খেলার মাঠ খুলে দেওয়া উচিত নয় বলেই মনে করি৷"
লকডাউনে মোবাইল আর TV-তেই মন শিশুদের৷ লকডাউন শিশুমনে ঠিক কতটা প্রভাব ফেলেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে মনোবিদ পর্ণাশা গুপ্ত রায় বলেন, "টানা লকডাউনে বড়রাই মাসনিক চাপে রয়েছেন ৷ বাচ্চাদের সমস্যা আরও বেশি ৷ অনেক বাচ্চার দুষ্টুমি বেড়ে যাচ্ছে ৷ পড়াশোনা করতে চাইছে না ৷ বাড়িতে ইনডিসিপ্লিনড্ কাজকর্ম বেশি করছে ৷ যেসব বাচ্চাদের মানসিক চাপ আগে থেকেই বেশি ছিল, লকডাউনে তাদের সমস্যা আরও বেড়েছে ৷ চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকায় তাদের সঙ্গে বাড়ির লোকজনের সমস্যাও বেড়ে গিয়েছে ৷ এই সব বাচ্চাদের রাগ, জেদ, অভিমান অন্য বাচ্চাদের থেকে বেশি ৷"
মনোবিদ পর্ণাশা গুপ্ত রায় বলেন, "লকডাউনের মধ্যে অনেক অভিভাবকই নানা সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন৷ মোবাইল ও টেলিভিশন দূরে সরিয়ে কীভাবে বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখা যায়, তা তাঁরা জানতে চাইছেন ৷ বাচ্চাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে মা-বাবাকেই এগিয়ে আসতে হবে ৷ নিজেদের ব্যস্ততার মধ্যেও বাচ্চাদের জন্য তাঁদের কিছুটা সময় বের করতে হবে ৷ ছোটবেলায় আমরা বাড়ির সবার সঙ্গে বসে লুডো, দাবা, ক্যারাম, কাটাকুটি খেলতাম ৷ এই খেলাগুলো যদি মা-বাবারা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে খেলেন, বাচ্চাদের মন ভালো থাকবে ৷"
এই বিষয়ে জেলার প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পার্থ দাশগুপ্ত বলেন, "লকডাউন শিশুমনে যে প্রভাব ফেলছে তা শুধু মালদা কিংবা ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ নয়, এটা গোটা বিশ্বের সমস্যা ৷ আগে তারা যতটা পরিসর পেত, এখন সেটাও পাচ্ছে না৷ অনলাইনে পড়াশোনা হচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে বাচ্চাদের সার্বিক লাভ হচ্ছে না ৷ বাচ্চারা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে কিংবা কথা বলতে পারছে না ৷ স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সান্নিধ্যে আসতে পারছে না ৷ বাড়িতে থাকার জন্যও অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের ৷ অন্যদিকে বড়রা কোরোনা আতঙ্কে ভুগছেন ৷ এতে মা-বাবারাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছেন, হতাশ হয়ে পড়ছেন ৷ তাঁরাও বাচ্চাদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করতে পারছেন না ৷ বাচ্চাদের সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলা কিংবা তাদের চাহিদা বোঝার চেষ্টা করছেন না ৷ উলটে অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাদের বকাবকি করছেন, মারধর করছেন ৷ এটাও এক ধরনের গার্হস্থ্য হিংসা ৷ সবটার প্রভাব পড়ছে শিশুমনে৷"
মনোবিদদের বক্তব্য, কবে কোরোনামুক্ত হবে পৃথিবী তা কেউ জানে না৷ অন্যদিকে, এখনই স্কুল খোলারও সম্ভাবনা নেই ৷ এই অবস্থায় বুদ্ধি করে ছোটোদের সময় দিতে হবে বড়দেরকেই ৷ তবেই ভালো থাকবে আগামী প্রজন্ম ৷