শ্রীচৈতন্যের আশ্রয় ভিটে নামে আজও প্রসিদ্ধ সেনদের দুর্গাপুজো মালদা, 16 অক্টোবর:মালদার অন্যতম প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজোর মধ্যে একটি হল সেনদের বাড়ির পুজো ৷ 170 বছর ধরে কোতোয়ালিতে রঘুনন্দন সেনের বাড়িতে কদম গাছের নীচে হয়ে আসছে উমার আরোধনা ৷ তবে এবারই সেই পারিবারিক ঐতিহ্যের ইতি ৷ কারণ আগামী বছর থেকে সেনদের দুর্গাপুজো পুরোদস্তুর সর্বজনীন রূপ পেতে চলেছে ৷ এক কথায়, এ বছরের মহাদশমী তিথিতে সেন পরিবারের সদস্যরা শেষবারের জন্য ঘরের মেয়েকে বিদায় জানাবেন ৷
শ্রীচৈতন্যের আশ্রয় ভিটে এটি ৷ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে নদীপথে মালদায় এসেছিলেন শ্রীচৈতন্য ৷ কালিন্দ্রী নদী বেয়ে তাঁর নৌকা সাঁঝবেলায় পেরোচ্ছিল বর্ধিষ্ণু কোতোয়ালির ব্রাহ্মণপাড়া ৷ রাতে নৌ যাত্রা করতে চাননি মহাপ্রভু ৷ নেমেছিলেন ব্রাহ্মণপাড়ার ঘাটে ৷ কিন্তু ওই পাড়ার মানুষ সেই রাতে তাঁকে আশ্রয় দেয়নি ৷ তাই তিনি রাতটুকু ঠাঁই নিয়েছিলেন রঘুনন্দন সেনের ভিটেয় থাকা কদম গাছের নীচে ৷ সেখানেই হয়ে আসছে মালদার অন্যতম প্রাচীন পারিবারিক দুর্গাপুজো ৷
দুর্গা দালানে পুজোর কথা বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়ছিলেন এই পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য নব্বই বছরের শরদিন্দু সেন ৷ তিনি জানালেন, এই পুজো শুরু হয়েছিল বর্ধমানের শ্রীখণ্ডে ৷ প্রয়াত রঘুনন্দন সেন এই পুজোর পত্তন করেন ৷ সেখানে তখন পুজোয় বলিদান প্রথা চালু ছিল ৷ পরবর্তীতে দেবীর স্বপ্নাদেশ পান তাঁর ঠাকুরদা যদুনন্দন সেন ৷ তাঁর কথায় পুজো এখানে নিয়ে আসেন রঘুনন্দন ৷ এই ভিটেতেই পাঁচশো বছরের বেশি আগে রাত কাটিয়েছিলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ৷ মহাপ্রভুর পরম ভক্ত রাধানাথ চৌধুরী পরবর্তীতে এখানে শ্রীচৈতন্যের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ৷ এই রাধানাথই রঘুনন্দন সেনকে দিয়ে শ্রীখণ্ড থেকে এখানে দুর্গাপুজো নিয়ে আসেন ৷ পুজো এখানে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বলিপ্রথা বন্ধ হয়ে যায় ৷ এই পুজোয় বৈষ্ণব ও শাক্ত, দুই ধর্মেরই উপস্থিতি পাওয়া যায় ৷ 1262 বঙ্গাব্দে এখানে পুজো চালু হয় ৷
আরও পড়ুন:'পতিতালয় নয়, সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধক গৃহের মাটি লাগে দুর্গাপুজোয়, বেশ্যা শব্দের অপব্যখ্যা চলছে সমাজে'
সেন বাড়ির পুজোর বিশেষত্ব হল, হিন্দুদের পাশাপাশি পুজোয় অংশ নেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা ৷ কোতায়ালির বিখ্যাত খান চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা এখানে অঞ্জলি দেন ৷ বংশপরম্পরায় সেই ধারা বজায় রয়েছে এখনও ৷ শরদিন্দু সেন বলেন, "আমাদের সঙ্গে এখানকার বিখ্যাত খান চৌধুরী পরিবারের খুব ভালো হৃদ্যতা রয়েছে ৷ আমার ঠাকুরদারা চার ভাই ছিলেন ৷ যদুনন্দন, জানকীনন্দন, গিরিজানন্দন এবং সুরেন্দ্রনন্দন ৷ এঁদের মধ্যে গিরিজানন্দন ছিলেন বিখ্যাত শিকারী ৷ এ দিকে বরকত গনি খান চৌধুরীর বাবা আবুল হায়াত খানও ছিলেন নামকরা শিকারী ৷ দু'জন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ বরকত সাহেবের ঠাকুরদা আরজুমান খান চৌধুরী আমাদের বাড়ির পুজোয় প্রথম অংশ নিয়েছিলেন ৷ তাঁর আমল থেকে এখনও পর্যন্ত খান চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা আমাদের পুজোয় অংশ নেন ৷ তাঁরা মায়ের পুজো দেন, পুষ্পাঞ্জলিও দেন ৷"
আরও পড়ুন:দেবীর হাতে অস্ত্রের বদলে পদ্ম, শিল্পের ছোঁয়া সোনাঝুরি জঙ্গলের হীরালিনী দুর্গাপুজোয়
সেন পরিবারে দশমীতে মাকে মেয়ে রূপে বিদায় দেওয়া হয় ৷ ঠিক যেভাবে বিয়ের পর মেয়েকে বিদায় দেন বাড়ির লোকেরা ৷ পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম রামানন্দ সেনের কথায়, "আমাদের এক শরিক এখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে বাইরে চলে গিয়েছে ৷ আমরা তিন শরিক মিলেই এখন পুজো করি ৷ সুরেন্দ্রনন্দনের বংশধররা এখানে আর আসে না ৷ এদিকে পুজোর খরচ দিনদিন বাড়ছে ৷ তাই এবারই আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু চাঁদা তুলে পুজোর আয়োজন করেছি ৷ আগামী বছর থেকে এই পুজো পুরোপুরি সর্বজনীন রূপ পাবে ৷ আমাদের রীতি অনুযায়ী সপ্তমীর সকালে পালকিতে চাপিয়ে কলাবউকে কালিন্দ্রী নদীতে স্নান করিয়ে দুর্গা দালানে নিয়ে আসা হয় ৷ দশমীতে মাকে বাড়ির মেয়ের মতো করে বিদায় দেওয়া হয় ৷ আগামী বছর থেকে এসব রীতি কতটা বজায় থাকবে জানা নেই ৷ সেই অনুযায়ী এবারই আমাদের পরিবারিক ঐতিহ্য মেনে শেষ বিদায় নেবেন মা ৷"