কলকাতা, 28 নভেম্বর : ইতিহাস বার বার সাক্ষী থেকেছে । হাজারো ঝড়ঝাপটা সামলে তিনি স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন বার বার । বিনা যুদ্ধে তিল পরিমাণ জমিও যে তিনি প্রতিপক্ষকে ছাড়েন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এ কথা বহু চর্চিত-বহু জনবিদিত । আজ পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর সদর, নদিয়ার করিমপুর এবং উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জে যে ভাবে মমতার জয়জয়কার, তা নিঃসন্দেহে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে বাড়তি অক্সিজেন দিল দলকে । শুধু বিধানসভা কেন, আগামী বছর পৌর ভোটের আগে গেরুয়া শিবিরের কাছে এই ফল বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে ।
লড়াইটা শুরু হয়েছিল বছর দুয়েক আগে পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে । সে সময় শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের একাধিক অভিযোগ উঠেছিল । পরের পরীক্ষা ছিল এ বছরের লোকসভা নির্বাচন । কিন্তু, কোথায় যেন সেই মমতা-মমতা হাওয়াটা ফিকে হয়ে গেছিল । বাংলার মাটিতে গেরুয়া ঝড়ের আভাস মিলছিল । স্বাভাবিক ভাবেই এই তিন উপ-নির্বাচন হয়ে গেছিল মমতার কাছে সম্মান রক্ষার লড়াই ।
তিন কেন্দ্রের মধ্যে নদিয়ার করিমপুরই একমাত্র তৃণমূলের দখলে ছিল । খড়গপুর সদর ছিল BJP-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দখলে । আর কালিয়াগঞ্জ কোনও বারই নিজেদের দখলে নিতে পারেনি তৃণমূল । মমতার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল নদিয়ার করিমপুরের আসনটি দখলে রাখা । আর বাকি দুটি আসনের ব্যবধান যতটা সম্ভব কমানো । আর সে কাজ হয়ে যাওয়ার পর খড়্গপুর সদর এবং কালিয়াগঞ্জ জয়ের জন্য ঝাঁপানো । সেই মতো ঘুঁটি সাজিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো । পরামর্শদাতার ভূমিকায় ছিলেন প্রশান্ত কিশোর । আজ ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল শেষ চালে বাজিমাত করে গেলেন মমতাই ।
বাম জমানার শুরু থেকে 2016 পর্যন্ত টানা 39 বছর বামফ্রন্টের বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে CPI(M)-এর দখলে ছিল করিমপুর । 2011 সালের পরিবর্তনের ভোটেও তা বামেদের হাতছাড়া হয়নি । 2016-র বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র প্রায় 16 হাজার ভোটে জিতে সেই গড় ছিনিয়ে নেন । কিন্তু লোকসভা ভোটে এক লাফে প্রায় 50 হাজার ভোট বাড়ায় এবার BJP প্রথম থেকেই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । তারা বুঝে গেছিল লড়াইটা মূলত তাদের সঙ্গে তৃণমূলের । গত লোকসভা ভোটের আগে নদিয়ার মাটি আকঁড়ে থেকে অভূতপূর্ব জয় এনেছিলেন মহুয়া । সেখানকার মানুষের কাছে 'দিদি' হয়ে উঠেছিলেন । আর এই আসনটা নিজেদের দখলে নিতে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন BJP-র মুকুল রায় । স্বাভাবিকভাবেই লড়াইটা দাঁড়িয়েছিল মহুয়া বনাম মুকুল । যে ভাবে মুকুলের হাত ধরে লোকসভা ভোটে বাংলায় গেরুয়া আবির উড়েছিল, তাতে মুকুলকেই অনেকে সামনের সারিতে রেখেছিলেন । প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন এলাকার পর এলাকা । কিন্তু, শেষ হাসি হাসলেন মমতাই । তৃণমূল প্রার্থী বিমলেন্দু সিংহ রায় জিতলেন বিপুল ব্যাবধানে ।
দ্বিতীয় লড়াইটা ছিল উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ । গত লোকসভা ভোটে উত্তরে গেরুয়া ঝড় দেখা গেছিল । আর কংগ্রেসের আলো বলতে ছিল শুধু প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্মৃতিটুকু । কিন্তু প্রিয়-হীন কালিয়াগঞ্জে এখন আর 'হাত' ধরার তেমন 'মন' নেই । অথচ স্বাধীনতার পর 11 বার হাতেই ভরসা রেখেছিল এই কালিয়াগঞ্জ । কয়েক বার জিতেছে CPI(M)। হাত-বামের এই আপাত 'ফাঁক' গলে পঞ্চায়েত ভোট থেকেই একটু একটু করে পদ্ম ফুটেছে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের গঞ্জ-গ্রামে । দশটি পঞ্চায়েতের মধ্যে ন'টিই পদ্ম-দখলে । আর গত লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জ জিতেছে BJP-ই । প্রায় দু’লাখ ভোটারের মন কালিয়াগঞ্জে কোনও দিনই জেতেনি ঘাসফুল । স্বাভাবিকভাবেই আশায় ঘর বেঁধেছিল গেরুয়া শিবির । কিন্তু, লোকসভা ভোটের পর নাগরিক পঞ্জি আতঙ্কে কিছুটা হলেও হাওয়া ঘুরেছে সীমান্তবর্তী কালিয়াগঞ্জে । 20শতাংশের কাছাকাছি সংখ্যালঘু ভোট এখানে । রাজনৈতিক মহলের অনুমান, সেই সংখ্যালঘুদের ভরসা পেয়েছে তৃণমূল । সংখ্যালঘুদের কাছে টানাতে পারায় প্রথমবার সেখানে ফুটল ঘাসফুল । 2016 সালে কংগ্রেসের প্রমথনাথ রায় পেয়েছিলেন 112868 ভোট । সেখানে এ বার তৃণমূলের তপনদেব সিংহ 97428 ভোট পেয়ে দু'হাজার বেশি ভোটে জিতলেন গেরুয়া প্রার্থী কমলচন্দ্র সরকারের থেকে ।
আর সব থেকে বেশি নজর ছিল সে আসনটাতে, সেটি দিলীপ ঘোষের ছেড়ে যাওয়া পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর সদর । খড়্গপুর সদর আসনে অবাঙালি ভোটের পরিমাণ বিপুল । 2014 সালে দিলীপ ঘোষ জেতার আগে পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচনেই খড়্গপুর থেকে অবাঙালি প্রার্থীরাই জিততেন । সে CPI-র নারায়ণ চৌবেই হন বা কংগ্রেসের জ্ঞান সিং সোহনপাল । ভোটের বাজারে দিলীপের সঙ্গে লড়াইটা দাঁড়িয়েছিল তৃণমূলের অন্যতম সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারীর । খড়্গপুর (সদর) বিধানসভার মধ্যে মূলত খড়্গপুর পৌর এলাকাই পড়ে । 2015 সাল থেকে খড়্গপুর পৌরসভায় ক্ষমতায় রয়েছে তৃণমূল । আর 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনে খড়্গপুর (সদর) কেন্দ্র থেকে জেতেন দিলীপ ঘোষ । পৌরপ্রধান প্রদীপ সরকার এ বার নিজেই উপ-নির্বাচনের তৃণমূল প্রার্থী । তাই তৃণমূল, BJP এবং বাম-কংগ্রেস জোট— তিন প্রার্থীর প্রচারেই বারবার উঠে আসছে শহরের উন্নয়ন প্রসঙ্গ । পৌরসভা কী কী কাজ করেছে, প্রচারে তার খতিয়ান তুলে ধরছে রাজ্যের শাসক দল । বিরোধীদের পালটা দাবি, পৌরসভার কাজে দুর্নীতি হয়েছে । কিন্তু, শেষ পর্যন্ত প্রদীপ সরকারে কাছে হার মানতেই হল BJP-র প্রেমচাঁদ ঝাঁকে ।
আজকের জয়ের পরই একবার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ''অহংকার এবং ঔদ্ধত্যের ফল পেল ওরা'' । টুইটারে তৃণমূল নেত্রী লেখেন, 'এক দুই তিন BJP-কে কবর দিন ৷ এটা মানুষের জয়, উন্নয়নের জয়, এই জয়ের কৃতিত্ব মানুষের ৷ ঔদ্ধত্যের সংস্কৃতি বাংলায় চলে না, বাংলার সংস্কৃতি হল সৌজন্যতা বিনিময় ৷ অহংকারের ফল পাচ্ছে BJP ৷ সংখ্যালঘু, আদিবাসী, রাজবংশী, সকলে আমাদের ভোট দিয়েছেন ৷ এই প্রথম আমরা খড়্গপুরে জিতলাম ৷'