পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

নন্দীগ্রামের লড়াই কি শুধুই মমতা বনাম শুভেন্দু ?

সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে খুব একটা পছন্দ করে না ৷ এই ধারণা খুব সম্ভবত এখন আর খুব একটা জোরের সঙ্গে বলা যায় না ৷ যেভাবে হায়দরাবাদে মিউনিসিপ্যালিটি ভোটে বিজেপির জয়জয়কার হয়েছে তা নিঃসন্দেহে গেরুয়া শিবিরে আশার আলো তৈরি করেছে ৷

নন্দীগ্রামের লড়াই কি শুধুই মমতা বনাম শুভেন্দু ?
নন্দীগ্রামের লড়াই কি শুধুই মমতা বনাম শুভেন্দু ?

By

Published : Mar 6, 2021, 10:14 PM IST

Updated : Mar 7, 2021, 12:19 PM IST

কলকাতা, 6 মার্চ : সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে টার্গেট করেই নন্দীগ্রামে নেত্রীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুভেন্দু অধিকারী ৷

সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রার্থী হলেন শুভেন্দু অধিকারী ৷ আশ্চর্য হলেও সত্যি ৷ তৃণমূল বা বিজেপি নয় ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন ৷ শুভেন্দু অধিকারী নন ৷ কর্ম তৎপরতা নয় ৷ নন্দীগ্রামে ভোট যুদ্ধের আসল সারথি হতে চলেছেন আব্বাস সিদ্দিকী এবং তাঁর ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট ৷

প্রায় 45 শতাংশ এই জেলায় সংখ্যালঘু ৷ আর এই ভোটব্যাঙ্কই এবারের বিধানসভা ভোটে পাখির চোখ ৷ নন্দীগ্রাম থেকে এখনও পর্যন্ত একটিবারও জয় পায়নি বিজেপি ৷ 2011 সাল পর্যন্ত এই আসনটা ছিল সিপিআইএমের হাতে ৷ 98-তে গঠিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস ৷ 13 বছরে তারা এই জেলাতে দাঁত ফোঁটানোর সাহস পায়নি ৷ বামেদের কিছু হটকারী সিদ্ধান্তে নন্দীগ্রামে 'সূর্যোদয়' হয়েছিল ৷ সুযোগ এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ৷ এই শুভেন্দু অধিকারীকে সঙ্গী করেই নন্দীগ্রামের বৈতরণী টপকে ছিলেন মমতা ৷ আজ কালের নিয়মে এই মমতার বিরুদ্ধেই শুভেন্দু ৷ সেদিন শুভেন্দুর জয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক ৷ আজ মমতা-শুভেন্দুর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়েও হাতিয়ার সেই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক ৷

সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে খুব একটা পছন্দ করে না ৷ এই ধারণা খুব সম্ভবত এখন আর খুব একটা জোরের সঙ্গে বলা যায় না ৷ যেভাবে হায়দরাবাদে মিউনিসিপ্যালিটি ভোটে বিজেপির জয়জয়কার হয়েছে তা নিঃসন্দেহে গেরুয়া শিবিরে আশার আলো তৈরি করেছে ৷ এই হায়দরাবাদে একের পর এক প্রচারে এসেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদিরা ৷ নিজামের শহরে নিজস্ব স্টাইলে প্রচার করেছিলেন তারা ৷ যোগী বলেছিলেন, হায়দরাবাদকে ভাগ্যনগর বানানোর কথা ৷ দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর তেজস্বী সূর্য অভিযোগ করেছিলেন, কেসিআর হায়দরাবাদকে ইস্তাম্বুল বানাতে চাইছেন ৷ এমন কড়া কড়া মন্তব্য সত্ত্বেও বিজেপি চার থেকে 48-এর উঠে আসে হায়দরাবাদে ৷

আরও পড়ুন : নন্দীগ্রামে শুভেন্দু, ডেবরায় ভারতী... বিজেপির আর কারা প্রার্থী ?

হায়দরাবাদের সেই সাফল্যকে হাতিয়ার করেই নন্দীগ্রামের মতো সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় নিজেদের ভোট ব্যাঙ্ক মজবুত করার কাজ শুরু করেছে বিজেপি ৷ তাদের তুরুপের তাস শুভেন্দু অধিকারী ৷ যে শুভেন্দু বরাবরই এক বিশেষ ধর্মীয় মোড়কে নিজেকে তুলে ধরতে পছন্দ করেছেন ৷ কংগ্রেস ঘরানায় জন্ম শুভেন্দুর ৷ কোনওদিন সরাসরি রাজনীতিতে আসবেন ভাবেননি ৷ বিভিন্ন আশ্রমেই ছোটোবেলায় তাঁকে দেখা যেত ৷ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন ৷ নিজস্ব একটা জনসমর্থক গোষ্ঠী ছিল তাঁর ৷ নন্দীগ্রামে যখন বামেরা শিল্পস্থাপনের কথা বলেছিলেন তখন জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন তৈরি হয় তার নেতৃত্বে ছিলেন সংখ্যালঘু মানুষরা ৷ যে আন্দোলনকে কাজে লাগিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ গোটা বিষয়টির নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছিল শুভেন্দুকে ৷ অধিকারী গড়ের এই মেজ ছেলেটি তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন ৷ সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে কাজে লাগিয়েছিলেন ৷ বাম বিরোধী যে হাওয়া সিঙ্গুর-ভাঙড় থেকে নন্দীগ্রামে গিয়ে পৌঁছেছিল তাকেই কাজে লাগিয়েছিলেন মমতা-শুভেন্দুরা ৷ সিপিআইএমের শক্ত ঘাঁটি নন্দীগ্রামে ঘটেছিল 'সূর্যোদয়' ৷ পালাবদল হয়েছিল ৷ জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস ৷ তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই নির্বাচনে আইএসএফ, মিমের মতো কোনও ধর্মীয় সংগঠনকে দেখা যায়নি ৷ বামেরাও তখন অস্তমিত ৷ সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক তখন পুরোপুরি তৃণমূলের হাতে ৷

2011-র এই ছবিটা দশ বছরে পুরোপুরি বদলে গিয়েছে ৷ গত দশ বছরে বামেরা আরও ছন্নছাড়া হয়েছে ৷ কার্যত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এখন লড়াই করছে ৷ যে নন্দীগ্রামে সিপিআইয়ের শক্ত ঘাঁটি ছিল সেখানে প্রার্থী দিতে ভয় পাচ্ছে বামেরা ৷ কংগ্রেস আগেই হাত গুটিয়ে নিয়েছে ৷ সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে কাজে লাগাতে সংযুক্ত মোর্চার অন্যতম আব্বাস সিদ্দিকীকে নন্দীগ্রাম ছেড়ে দিতে বাধ্যা হয়েছে বামফ্রন্ট ৷ যাতে সিদ্দিকী নন্দীগ্রামে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে কাজে লাগাতে পারেন ৷ এই সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক যদি সিদ্দিকীর পক্ষে যায় তাহলে মমতা এবং শুভেন্দুর ক্যারিশ্মাই নন্দীগ্রামে জয়ের চাবিকাঠি হবে ৷ আর যদি না হয় ?

আরও পড়ুন : পারিবারিক কুৎসার পরিবর্তে বাংলার উন্নয়নের কথা বলুক প্রধানমন্ত্রী : ফিরহাদ

আব্বাসের দল কতটা ভোট কাটতে পারবে ? বিজেপির দিক থেকে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক আদৌ সরে যাবে কি না ৷ মমতা সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ককে কাজে লাগাতে পারবেন কি না ৷ এই তিনটি বিষয়ই নন্দীগ্রামে মূল ফ্যাক্টর হতে চলেছে ৷

2011-র আগে প্রতিটি ভোটে দেখা গিয়েছিল মুসলিমরা বামফ্রন্ট বা সিপিআইএমকে ভোট দিয়েছে ৷ কিছু অংশ অবশ্যই কংগ্রেস পেয়েছিল ৷ 2011-র পর থেকে তৃণমূল মুসলিম ভোট ধারাবাহিকভাবে পেয়ে এসেছে ৷ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে 2019 সালে ৷ দেখা গিয়েছে উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘুরা বিজেপিকে পছন্দ করছে ৷ এবারের ভোটে মুসলিম আনুগত্য কতটা পাবে তা নিশ্চয় তৃণমূল এবং বিজেপি পুরোদস্তুর সমীক্ষা করেছে ৷ আর এই সমীক্ষার মধ্যে নতুন কাঁটা অবশ্যই মিম এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট ৷ মুসলিম ভোট ভয়ঙ্করভাবে কাটাকাটি হলে নন্দীগ্রামে বিজেপির হাত অবশ্যই শক্ত হবে ৷ মুসলিম ভোট টানার ক্ষেত্রে তৃণমূলের একটা দুর্বলতা রয়েছে ৷ দলে তেমনভাবে কোনও সংখ্যালঘু মুখ নেই ৷ যারা গ্রামীণ ভোট ব্যাঙ্ককে টানতে পারেন ৷ এই মুসলিমদের মধ্যে কিন্তু মিম তথা আসাদউদ্দিন ওয়েইসি এবং আইএসএফ তথা আব্বাস সিদ্দিকীর একটা জনপ্রিয়তা আসে ৷

রাজনৈতিক মহলের অনুমান মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ককে টানার ব্যর্থতার কথা আগেই উপলব্ধি করেছিলেন মমতা ৷ আবার বহিরাগত তত্ত্বও সামনে আসার ভয় ছিল ৷ এই দুই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতেই নন্দীগ্রামকে মেজো বোনের আসনে বসিয়ে সেখানে লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছিলেন ৷ এর কারণ ৷ এক) যাতে সংখ্যালঘুরা রুষ্ট না হন ৷ দুই ) বহিরাগত তত্ত্ব খাড়া না হওয়া ৷ তিন) মমতার জনমোহিনী ক্যারিশ্মাকে কাজে লাগানো ৷ চার ) নন্দীগ্রামের পাশেই তিনি আছেন সেটা প্রমাণ করা ৷ পাঁচ ) শুভেন্দু সবসময় তৃণমূলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ৷ এই চ্যালেঞ্জকে অন্য কারও সামনে ফেলার সাহস না দেখানো ৷

শুভেন্দুর ক্ষেত্রেও মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে চলেছে ৷ কারণ ৷ এক) হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের পাশাপাশি কতটা সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক টানতে পারেন ৷ দুই ) দশ বছর তৃণমূলের মন্ত্রিসভায় থাকার পর বিজেপিতে আসা ৷ গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা ছিল ৷ সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা ৷ এর জন্য নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো ৷ তিন) নন্দীগ্রামে অধিকারী পরিবারের মর্যাদাকে কাজে লাগানো ৷

কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াটা নির্ভর করছে সেই আব্বাস সিদ্দিকী এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের উপর ৷ কারণ তারা কতটা জনসমর্থন আদায় করবে তার উপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে ৷ একইরকমভাবে নন্দীগ্রামের মতো পরিস্থিতি ভাঙড়েও ৷ এই সংখ্যালঘুর ভোট ব্যাঙ্ককে নিজের দিকে রাখতে তৃণমূল রেজাউল করিমকে প্রার্থী করেছে সেখানে ৷ বামেরা এই আসনটাও ছেড়ে দিয়েছে আব্বাস সিদ্দিকী তথা আইএসএফকে ৷ এইখানেও গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হতে চলেছেন আব্বাস ৷

Last Updated : Mar 7, 2021, 12:19 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details