কলকাতা, 30 সেপ্টেম্বর : COVID-19-এর জেরে ভিটামিন ওষুধের বিক্রি বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে । এদিকে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অনেকে যেমন ভিটামিন ওষুধ খাচ্ছেন, তেমনই, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অনেকে আবার নিজেরাই ভিটামিন ওষুধ খাচ্ছেন । চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পরামর্শ না মেনে ভিটামিন ওষুধ খাওয়া হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এবং, COVID-19-এর সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই সব থেকে বড় উপায়।
COVID-19-এর সংক্রমণের জেরে ভিটামিন ওষুধের বিক্রি বা ব্যবহার অনেক বেড়ে গিয়েছে। এর কারণ হিসাবে ইনফেকশাস ডিজ়িজ়েস অ্যান্ড বেলেঘাটা জেনারেল (ID&BG) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান, চিকিৎসক তপন বিশ্বাস বলেন, "COVID-19 একটি ভাইরাল ডিজ়িজ়। এই রোগের চিকিৎসার জন্য এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ বের হয়নি। এখনও পর্যন্ত ভ্যাকসিন বের হয়নি। যে কোনও সংক্রমিত রোগের মূল কারণ হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট জীবাণু, হোস্ট ডিফেন্স এবং পরিবেশ। আমরা যদি হোস্ট ডিফেন্স একটু বাড়িয়ে দিতে পারি, তা হলে জীবাণুর সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা অনেকটা বেশি হবে। এর ফলে কমপ্লিকেশনগুলি কম হয় ।"
কিন্তু, ভিটামিন ওষুধের অপব্যবহার অর্থাৎ, যে ভিটামিনের প্রয়োজন নেই, অথবা যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, এটা ভিটামিনের একটি গ্রুপ, ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, সাধারণত, এই তিনটি ভিটামিন এবং, এর সঙ্গে কিছু মিনারেল যেমন জিঙ্ক । এই ভিটামিনগুলিই COVID-19-এর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। একথা জানিয়ে চিকিৎসক তপন বিশ্বাস বলেন, "এই ভিটামিন ওষুধগুলি শুধুমাত্র COVID-19-এর জন্য নয়। অন্য যে কোনও ভাইরাল বা, ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ যদি হয়, তা হলেও এগুলির ব্যবহার হয়। COVID-19 রোগীদের শরীরের ইমিউনিটি বাড়ানোর জন্য ভিটামিনের সঙ্গে জিঙ্ক দেওয়া হচ্ছে । ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, এটা সার্বিকভাবে শরীরের মেটাবলিজ়ম বৃদ্ধি করে।" এদিকে, ভিটামিন বি এবং ভিটামিন সি, এই ভিটামিনগুলির যতটা প্রয়োজন হয়, ততটা আমাদের শরীর রেখে দেয়। বাকিটা ইউরিনের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ভিটামিন সি বেশি পরিমাণে খেলে কিডনিতে স্টোন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ভিটামিন ডি বেশি খেলে লিভারে জমা হতে থাকে । ফলে ধীরে ধীরে ড্যামেজ হতে থাকে লিভার। ভিটামিন ই, ভিটামিন এ, এগুলি বেশি খাওয়া হলে হাইপোভিটামিনোসিস সিনড্রোম দেখা দেয়। এর জন্য লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ব্রেন ঠিক মতো কাজ করে না। শরীরের উপকারের জন্য খাওয়া হচ্ছে, সেটা না হয়ে অপকার হয়।" ভিটামিন ওষুধ বেশি দিন খাওয়া উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া প্রতিদিন র্যানডমলি ভিটামিন ওষুধ খেলে শরীরের এই বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম ধারণা রয়েছে, প্রতিদিন ভিটামিন ওষুধ খেলে রোগ-ব্যাধি হবে না। এটা একেবারেই ভুল ধারণা। বেশি ভিটামিন শরীরের কোনও কাজে লাগে না। কিছু ভিটামিন শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, কিছু ভিটামিন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জমা হয়ে, ওই অঙ্গগুলিকে ড্যামেজ করে। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খায়, তাতে যে ভিটামিন রয়েছে, তা আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট। অতিরিক্ত ভিটামিন ওষুধের দরকার হয় না ।" অথচ দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া সাধারণ মানুষের অনেকে ভিটামিন ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের ক্ষতি নিজেরা করছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। COVID-19-এর ক্ষেত্রে দুই সপ্তাহের জন্য ভিটামিন ওষুধ দেওয়া হচ্ছে । ভিটামিন এবং জিঙ্ক মিশ্রিত ওষুধ, ভিটামিন ডি, ভিটামিন সি ওষুধ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে আগে থেকেই প্রেসক্রাইবড করা হচ্ছিল। এটা COVID-19-এর জন্য নতুন নয়।"
যদিও, ভিটামিন খেলে যে কোরোনা হবে না সেই তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতার বেসরকারি একটি শিশু হাসপাতালের অধিকর্তা, চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ৷ তিনি বলেন, "অনেকে হয়তো বলবেন, ভিটামিন খেলে উপকার হতে পারে। কেউ বলছেন, ভিটামিন সি খেলে উপকার হতে পারে। তার কিন্তু কোনও প্রমাণ কিছু নেই । আরও অনেক ওষুধ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলি খেলে প্রতিরোধ করা যাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এখনও পর্যন্ত জানি যে, এই ধরনের ওষুধের লাভ কিছু নেই ।" এদিকে, এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "আমরা দেখতে পাচ্ছি COVID-19-এর অতিমারীতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ওষুধকে প্রোমোট করা হচ্ছে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। এটা একটা অসাধু ব্যবসা বা অসাধু পরিকল্পনা বলে আমরা মনে করি । আমাদের শরীরে ইমিউন সিস্টেম তৈরি হতে সময় লাগে। আজকে ভিটামিন ওষুধ খেলাম আর কালকে ইমিউনিটি পাওয়ার তৈরি হয়ে যাবে, এটা বাস্তব নয়। কেউ যদি মনে করেন, তিনি ভিটামিন ওষুধ খাচ্ছেন, তার মানে তাঁর ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গিয়েছে, COVID-19 হবে না, তাহলে তিনি ঠকবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই COVID-19-এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার সব থেকে বড় উপায় ।" তিনি আরও বলেন, "সাধারণ মানুষের কাছে আমাদের আবেদন, চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ভিটামিন ওষুধ খাওয়া উচিত । ভিটামিন ওষুধ বিশেষ করে ভিটামিন এ যদি বেশি খাওয়া হয়, তাহলে তার থেকে হাইপারভিটামিনোসিস তৈরি হয়। এর কতগুলি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।"
COVID-19-এর জেরে ভিটামিন ওষুধের বিক্রি কি বেড়ে গিয়েছে? কলকাতার একটি ওষুধের দোকানের মালিক সঞ্জয়কুমার মুকিম বলেন, "ভিটামিন ওষুধের বিক্রি আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। বলা যায়, 100 শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। ভিটামিন সি, ভিটামিন ডি, মাল্টিভিটামিন ওষুধ প্রেসক্রাইব করছেন চিকিৎসকরা। অনেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াও ভিটামিন ওষুধ কিনতে আসেন। ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়ানোর জন্য ভিটামিন ওষুধ খেতে বলছেন চিকিৎসকরা । ক্রেতাদের কোনও দোষ নেই । COVID-19-এর থেকে বাঁচার জন্য খেতে হবে ।" কলকাতার অন্য একটি ওষুধের দোকানের এক কর্মী বাবাই কুন্ডু বলেন, "ভিটামিন ওষুধের ডিমান্ড মাঝখানে বেড়ে গিয়েছিল। সেই তুলনায় এখন একটু কম আছে। কিন্তু, এখনও অনেকে ভিটামিন ওষুধ কিনছেন। ভিটামিন ওষুধ কেনার জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসছেন অনেকে, প্রেসক্রিপশন না নিয়েও অনেকে কিনতে আসছেন। ভিটামিনের সব ওষুধ কম বেশি বিক্রি হচ্ছে ।"