কলকাতা, 14 এপ্রিল : কোরোনা মোকাবিলায় চলছে লকডাউন । রাজ্যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ । এর জেরে গৃহবন্দি পড়ুয়ারা। পরীক্ষা, রেজ়াল্ট, পরবর্তী ধাপের পড়াশোনা নানা চিন্তায় অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে । এবার বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ কলেজগুলির পড়ুয়াদের জন্য টেলি-কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম চালু করেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আর এই প্রোগ্রামে পড়ুয়াদের ব্যাপক সাড়া মিলেছে । অনেকেই অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের কাছ থেকে নানা বিষয়ে পরামর্শ নিচ্ছেন ।
লকডাউনে পাশে, পড়ুয়াদের টেলি কাউন্সেলিং চালু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
8 এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এই টেলি-কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সাইকোলজি বিভাগের পাঁচজন অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ও অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি বিভাগের আট জন অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ।
8 এপ্রিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে চালু করা হয় এই টেলি-কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম। ইতিমধ্যেই সাইকোলজি বিভাগের পাঁচজন অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ও অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজি বিভাগের আটজন অধ্যাপক-অধ্যাপিকার নাম, ফোন নম্বর, যোগাযোগের সময় সহ নানা তথ্য দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। কাউন্সেলিংয়ের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে পড়ুয়াদের থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে কাউন্সেলিং সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের কাছে ফোন, মেসেজ আসা শুরু হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ কলেজগুলির পড়ুয়াদের পাশাপাশি বেশ কয়েকজন প্রাক্তনীও নিজেদের সমস্যা অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের জানাচ্ছেন। তাঁরা আরও জানান, পড়ুয়ারা প্রথমে একটু দ্বিধা নিয়েই ফোন করছে। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকরা প্রথমে ফোন করে বলছেন, পড়ুয়া কথা বলতে চায়। তারপরে কথা বলতে বলতে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠছে সেই পড়ুয়ারা। তাঁদের কথাতেই স্পষ্ট যে, এই কাউন্সেলিং প্রোগ্রামটার ভীষণ প্রয়োজন ছিল তাদের।
কাউন্সেলিং প্রোগ্রামে পড়ুয়াদের ব্যাপক সাড়া পাওয়ার বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপিকা সংযুক্তা দাস বলেন, "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে খুব ভালো একটা পদক্ষেপ। খুব ভালো সাড়া মিলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিভিন্ন কলেজের, বিভিন্ন শাখার পড়ুয়ারা ফোন করছে। আমার কাছে প্রত্যেকদিন গড়ে 4-5 টা করে ফোন আসছে। ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়ে তো ওরা। প্রথমে একটু দ্বিধা নিয়েই ফোন করছে। কিন্তু, কথা বলতে বলতে ওরা সাবলীল হয়ে উঠছে । খুব ভালো লাগছে।"
সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপিকা তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় বলেন, "খুব ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। বহু পড়ুয়া নির্দ্বিধায় ফোন করছে আমাদের। আমার কলিগদের থেকেও জানতে পারলাম, প্রত্যেকের কাছেই বহু কল আসছে। আমি এখনও পর্যন্ত অন্তত 30-35 টি ফোন পেয়েছি। শুধু নির্দিষ্ট সময়ে নয়, সময়ের বাইরেও ফোন আসছে।"
কী ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে পড়ুয়াদের মধ্যে? মূলত, লকডাউনের জেরে মানসিক অবসাদ ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে পড়ুয়াদের মধ্যে। সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সোমদেব মিত্র বলেন, "কেউ কেউ পরীক্ষা কবে হবে সেই উদ্বেগ থেকে ফোন করছে। সেটা নিয়ে আমরা তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা যে এখনই কিছু জানা যাবে না। কর্তৃপক্ষ যখন সিদ্ধান্ত নেবে তখনই জানা যাবে। অবসাদের বিষয়টা একাধিকের মধ্যে পেয়েছি। সারাদিন কী করে কাটাব বুঝতে পারছি না, কবে কী হবে সেই অনিশ্চয়তাটাও কাজ করছে ওদের মধ্যে। এই সময়টাতে পড়াশোনার ব্যাপারও থাকছে । আমরা একটা রুটিন তৈরি করে দিচ্ছি। সেই রুটিনে পড়াশোনাটাকে রাখার কথা বলছি। পড়াশোনাটা আসলে নিজেকে ব্যস্ত রাখার, মানসিক স্বাস্থ্যটাকে একটা অভ্যাসের মধ্যে রাখার উপায়। আবার যখন লকডাউনটা উঠবে তখন দৌড় শুরু হবে। এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পড়াশোনার চর্চার মধ্যে আমরা যাতে থাকি, পুরোপুরি অবসাদের মধ্যে চলে না যাই ।"
অধ্যাপিকা সংযুক্তা দাস বলেন, "বিভিন্ন রকম সমস্যা আছে। কারও পরীক্ষা শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে । আগামীদিনে আরও অনেক পরীক্ষা ছিল, সেগুলো কবে হবে বুঝতে পারছে না। ফলে, মোটিভেশন হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকের আগের সমস্যা ছিল কিছু। এখন তো বাচ্চারা কলেজ, বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ফলে, তাঁরা অনেকেই গুটিয়ে যাচ্ছে, আগের সমস্যাগুলি বেড়ে যাচ্ছে। তবে, লকডাউনের কারণে অবসাদে ভোগার সমস্যা 90 শতাংশ আসছে। কী করব বুঝতে পারছি না, খালি খালি লাগছে, পড়তে হবে বুঝতে পারছি, কিন্তু, পড়তে পারছি না। ডিপ্রেশন হয়ে যাচ্ছে। নানা অভিযোগ । এই খালি খালি ব্যাপারটা থেকে কীভাবে বের হতে পারবে পড়ুয়ারা, সেটা বলার চেষ্টা করছি আমরা ।"
অধ্যাপিকা তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায় বলেন, "পড়ুয়ারা আমাদের সঙ্গে কমফর্টেবল ফিল করছে। শুধু COVID রিলেটেড নয়। আরও অনেক সমস্যা, অনেক কিছু ওরা বলছে। সাধারণত যে সমস্যা দেখছি সেটা হল, পড়ুয়াদের মনে পরীক্ষা সংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন উঠছে। কোয়ারান্টাইনে থাকাকালীন সমস্যা তো রয়েছে। সেগুলি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কেরিয়ার নিয়েই মূলত অনিশ্চয়তার সমস্যা নিয়ে ওরা আসছে। বোঝালে আবার বুঝতে পারছে বিষয়গুলি । বুঝতে পারছে যে, ওরা যে একা নয়, অন্যরাও সঙ্গে রয়েছে । যেটা হবে সেটা সবার একসঙ্গেই হবে।"
সাইকোলজি বিভাগের 5 জন অধ্যাপক-অধ্যাপিকার জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট এক ঘন্টা সময় ও অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজির 13 জন অধ্যাপক-অধ্যাপিকাকে সপ্তাহের নির্বাচিত দিনে নির্দিষ্ট এক ঘন্টা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপক-অধ্যাপিকাকে নিজেদের সমস্যা নিয়ে ফোন করতে পারবেন পড়ুয়ারা। কিন্তু, প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও ফোন পাচ্ছেন তাঁরা। বহু ক্ষেত্রেই সমস্যা বুঝে ফলো-আপের ব্যবস্থা করছেন অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। প্রথমবার সমস্যা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ফলো-আপ ব্যবস্থাও পড়ুয়াদের আশ্বস্ত করছে বলে মত তাঁদের। সংযুক্তা দাস বলেন, "আমাদের তো নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। সেক্ষেত্রে কাউকে কাউকে আমরা আবার ফলো-আপ করতে বলছি পরে। সেটা আর ওই সময়ের মধ্যে রাখছি না।
সবমিলিয়ে পড়ুয়াদের জন্য যে এই উদ্যোগটার খুব প্রয়োজন ছিল তা একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। সংযুক্তা দাস বলেন, "আমার খুব ভালো লাগছে যে, আমরা এই বিপদের সময় পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়াতে পারছি। ওদের কাছে পৌঁছাতে পারছি।"