কলকাতা, 13 অগাস্ট : প্রায় প্রতিদিনই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে স্মাগলাররা । ধরা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে তারা বোমা ছুঁড়ছে । গুলি চালাচ্ছে । নানা ভাবে আক্রমণ করছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে । তবে, যেসব দুষ্কৃতীরা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ছে তারা পাচার চক্রের কিংপিন নয় । চক্রের পান্ডারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ঠান্ডা ঘরে বসে চালাচ্ছে এধরনের কাজ । তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায় না বললেই চলে । তার ফলেই সীমান্তে সোনা, মাদক, গোরু পাচার চলছে । এমন কী বাদ নেই মানবপাচারও । এমনই জানাচ্ছেন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর DIG এস এস গুলেরিয়া । ETV ভারতের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে জানালেন সীমান্তের স্মাগলিং নিয়ে অনেক অজানা কথা ।
প্রশ্ন :প্রায় প্রতিদিনই আপনাদের লক্ষ্য করে বোমা মারছে দুষ্কৃতীরা । আহত হচ্ছেন জওয়ানরা । কেন আক্রমণ করা হচ্ছে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে?
গুলেরিয়া :দেখুন দুষ্কৃতীরা সীমান্তকে ব্যবহার করে পাচার করতে চায় । এটাকে সহজে টাকা রোজগারের একটা পন্থা ভেবে নিয়েছে তারা । বাংলাদেশ সীমান্ত ভীষণভাবেই স্পর্শকাতর । সীমারেখায় ভারত-বাংলাদেশ উভয়পক্ষের বহু মানুষ থাকেন । এই মানুষজনের অনেকেই এই পাচারকে নিজের লাইফস্টাইল বানিয়ে ফেলেছে । অনেক বাংলাদেশি সীমান্ত পার হয়ে এদেশে ঢোকার চেষ্টা করে । আমরা যতটা পারি তাদের আটকাই । স্মাগলিংয়ের জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করি । তার জেরে সংঘর্ষ হয় । সেই সময় পাচারকারিরা দা, হাই বিম টর্চ, বাঁশ, দেশি বোমা এমন কী পিস্তল নিয়েও আক্রমণ করে । যখন এই ধরনের পরিস্থিতি হয়, তখন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি । যাতে এদের পাকড়াও করা যেতে পারে । কিন্তু যখন সেটা জীবনের প্রশ্ন হয়ে ওঠে তখন আমরা নন লিথিয়াল ওয়েপন দিয়ে ওদের আহত করে ধরার চেষ্টা করি । যাতে পাচার বন্ধ করা যায় ।
প্রশ্ন :শুধুমাত্র গোরু নয় । আরও অনেক কিছু পাচার হয় সীমান্ত দিয়ে । সেগুলো ঠিক কী?
গুলেরিয়া : সীমান্ত দিয়ে সব থেকে বেশি পাচার হয় গোরু । এই পাচার নিয়ে আরও অনেক অপরাধ জড়িয়ে রয়েছে । এখানে সোনা, জাল নোটসহ গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল পাচার হয় । গাঁজা, ফেনসিডিলের মতো মাদক এদেশ থেকে ওদেশে যায় । আবার জালনোট, ইয়াবা বাংলাদেশ থেকে এদেশে ঢোকে । আমরা সম্পূর্ণ চেষ্টা করি এই স্মাগলিং আটকানোর । তবে সব থেকে বড় সমস্যা বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার । আর এতে জড়িয়ে রয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন । সেটা সমস্যাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয় ।
প্রশ্ন :কিন্তু কেন এই পাচার? কী মনে হয় আপনার ?
গুলেরিয়া :দেখুন কিছু লোভী মানুষ সীমান্ত চত্বরে থাকে । যারা রাতারাতি ধনী হতে চায় । তারা এই বেআইনি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে । আর এটাই পাচারচক্রে যোগদানের মূল কারণ হয় তাদের । এর জন্যই তো পাচারচক্র ও সেখানে লোকজন বাড়ে ।
প্রশ্ন : রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ আপনাদের সাহায্য করে?
গুলেরিয়া :বর্ডার ম্যানেজমেন্ট খুব একটা বড় বিষয় । এখানে সীমান্তরক্ষী বাহিনী শুধুই একটা স্টেকহোল্ডার । কিন্তু আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে । স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, সিভিল সোসাইটি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, এমন কী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশও সীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশ । যখন সবাই মিলে এই কাজ করা হবে তখন কার্যকরী সীমান্ত সুরক্ষা করা যাবে ।
প্রশ্ন : এই বর্ষায় সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়ে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন আপনারা?
গুলেরিয়া : সীমান্তের যেসব জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া আছে সেখানে গোরু পাচার বন্ধ হয়ে গেছে বলা চলে । কিন্তু বেশ কিছু বর্ডার আউটপোস্ট আছে যেমন মালদা, মুর্শিদাবাদের হারু ডাঙা, শোভাপুর বর্ডার আউটপোস্ট, বইরাডাঙা, নিমতিতা, ভাগীরথীর মতো বর্ডার আউটপোস্ট যেগুলি গঙ্গার তীরে অবস্থিত সেখানে কোন ফেন্সিং নেই । বর্ষায় যখন এই জায়গাগুলোতে বন্যা চলে আসে, তখনই হয় সমস্যা । সীমান্তে তিন চার কিলোমিটার দূরের গ্রাম যেমন ধুলিয়ান, ডিস্কো বোর্ডের মতো বেশ কিছু গ্রাম থেকে স্মাগলাররা রাতের অন্ধকারে গোরু কলাগাছের মাঝে বেঁধে জলে ছেড়ে দেয় । গোরু সাঁতার কেটে বাংলাদেশের দিকে চলে যায় । বাংলাদেশি পাচারকারীরা ওপারে বোটের মাধ্যমে এই গোরুদের ধরে নেয় । আমাদের কাছে তখন যে টুকু সময় থাকে তার মধ্যে আমরা স্পিডবোট কাজে লাগিয়ে যত বেশি সম্ভব গোরু উদ্ধারের চেষ্টা করি । এভাবে আমরা 50 থেকে 60 শতাংশ গোরু ধরে ফেলতে পারি । কিন্তু অস্বীকার করার জায়গা নেই কিছু গোরু তো ওপারে চলেই যায় । এটা বন্ধ করতে আমরা ওই সব এলাকায় আরও বেশি করে ফোর্স রেখেছি । ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ক্যামেরা । সীমান্তরক্ষী বাহিনী সর্বদা সজাগ রয়েছে । একইসঙ্গে আপনারা জানেন সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে যে যৌথ অপারেশনের কথা হয়েছে তা অনেকটাই ফল দেবে বলে মনে করছি আমরা ।
প্রশ্ন : শেষ প্রশ্ন, এই পাচারের মাস্টারমাইন্ড তো কেউ আছে । তাদের নিয়ে কী ভাবছেন?
গুলেরিয়া :এটা সত্যি আমরা ভারতীয় কিংবা বাংলাদেশের যে পাচারকারীদের ধরি ওরা শুধুই ক্যারিয়ার । যাদের রাখাল বলা হয় । তাদের পাকড়াও করা হয় । জেরা করা হয় । কিন্তু দেখা যায় তাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই । কিংপিনদের বিরুদ্ধে খুব একটা প্রমাণ থাকে না । যারা আসলে পাচার করে তাদের বিরুদ্ধে খুব বেশি তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না । আমরা যেটুকু তথ্য পাই তার ভিত্তিতে পুলিশে মামলা করি । অতীতে যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পেয়েছি তা তুলে দিয়েছি পুলিশের হাতে । কারোর বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও চলছে । ওরা ধরে পড়ে না সেটা হয়ত ঠিক নয় । কিন্তু এটাও ঘটনা তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত হলে এই পাচার অনেকটাই বন্ধ হতে পারে ।