হাইকোর্টের মন্তব্য কমিশনের কাছে লজ্জার কলকাতা, 21 জুন: 'পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ ৷' বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা ধার করেই বলতে হয়, বুধবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে আদতে পথ হারানো পথিকের সঙ্গে তুলনা টেনে ভর্ৎসনা করলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ৷
'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসে নবকুমারের উদ্দেশে মার্গদর্শনের বার্তা শেনা গিয়েছিল সাহিত্য সম্রাটের লেখনীতে ৷ তবে তার মধ্যে ছিল পথ দেখানোর স্পষ্টতা ও শিক্ষনীয় বার্তা ৷ বুধবার কার্যত যেন সেই পথে হেঁটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে আরও একবার নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করল কলকাতা হাইকোর্ট ৷ এবার অবশ্য শান্তভাবে না, কমিশনকে রীতিমতো তিরস্কার করল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানমের বেঞ্চ ৷ এমনকী রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অশান্তি, হিংসা, রক্তপাতের যে দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে, তাতে হাইকোর্ট যে তিতিবিরক্ত তা ফের স্পষ্ট হয়েছে কমিশনের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতির কড়া মন্তব্য থেকে ৷ এদিন প্রধান বিচারপতি সাফ জানিয়েছেন, নিরপেক্ষ নির্বাচন করাতে কমিশন ব্যর্থ হলে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীবা সিনহা পদ থেকে অব্যাহতি নিন ৷
মনোনয়ন পর্ব থেকে শুরু হয়েছে রাজ্যের অশান্তির ছবি ৷ দিন যত গড়িয়েছে হিংসা বেড়েছে জেলায় জেলায় ৷ এমনকী মনোনয়নের প্রথম দিন থেকে রক্তপাতের যে সূত্রপাত হয়েছিল 12 দিন পরও তা অব্যাহত রয়েছে রাজ্যে ৷ মনোনয়নের দিন থেকে এদিন পর্যন্ত মোট সাত জনের মৃত্যু হয়েছে এই পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে ৷ যদিও মামলার প্রথমদিন থেকেই এই রক্তপাত এবং মৃত্যুর পরও রাজ্য নির্বাচন কমিশন বা রাজ্য প্রশাসন যে নিষ্ক্রীয়, সে বিষয়ে নিজেদের আশঙ্কা গোপন করেননি বিচারপতিরা ৷ উষ্মা প্রকাশ করে ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন খোদ প্রধান বিচারপতি ৷ কিন্তু সেই নির্দেশ পালন তো দূরঅস্ত, তার ধার কাছ দিয়েও মাড়াতে দেখা যায়নি রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ৷ আর তার পরিণাম হয়েছে মারাত্মক ৷ পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে খোদ হাইকোর্টে দায়ের হওয়া একাধিক মামলায় বিভিন্ন বিচারপতির পর্যবেক্ষণেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, নির্বাচনকে ঘিরে উত্তোরোত্তর সন্ত্রাস এবং হিংসা রাজ্যে বেড়েছে বৈ কমেনি ৷
আরও পড়ুন:কমিশনকে 80 হাজারের বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান মোতায়েনের নির্দেশ হাইকোর্টের
এদিন একদিকে হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা অন্য একটি মামলায় ক্ষোভের সঙ্গে মন্তব্য করেন, "যদি একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে এত রক্তপাত, হিংসা হয় তবে নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ ৷" আর অন্যদিকে, কার্যত রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন খোদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ৷ এদিন কেন্দ্রীয় বাহিনী সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে তিনি মন্তব্য করেন, "আদালতের নির্দেশ পালন করতে না পারলে পদ ছেড়ে দিতে পারেন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ৷ সে ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে পারেন ৷" সরাসরি না-বললেও কমিশনারকে কার্যত কান ধরে হাইকোর্ট বুঝিয়ে দিলেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীবা সিনহা পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন ৷ আর আদালতের এই মন্তব্য নিয়ে প্রাক্তন রাজ্যপাল তথাগত রায় বলেন, "হাইকোর্ট যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষে যথেষ্ট লজ্জাজনক ৷ এর অর্থ হচ্ছে কমিশনার নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না ৷ কমিশনের উচিৎ প্রকাশ্য়ে নিজেদের দোষ স্বীকার করা এবং হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক নিজেদের শুধরানো ৷"
আরও পড়ুন:পঞ্চায়েত ভোটে নথি বিকৃতির অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ হাইকোর্টের
একই সঙ্গে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণের পর যদি রাজীবা সিনহা পদত্যাগ করেন সেক্ষেত্রে কী হতে পারে ? প্রাক্তন রাজ্যপালের দাবি, এক্ষেত্রে রাজ্যপাল কমিশনারের পদত্য়াগ পত্র রাজ্য মন্ত্রিসভার কাছে পাঠাবেন ৷ এবং নতুন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের নিয়োগের জন্য আবেদন করবেন ৷ তিনি বলেন, "সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের মধ্য়ে যে ভারসাম্য বজায় রাখা উচিৎ সেসব দিক বিবেচনা করেই প্রধান বিচারপতি এই নির্দেশ দিয়েছেন ৷ তবে রাজ্যপালের সেই ক্ষমতা আছে যে রাজ্যের তরফে যে নাম পাঠানো হবে তার মধ্যে একজনকেও তিনি পছন্দ নাও করতে পারেন ৷"
অন্যদিকে, এদিন প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যকে 'অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ' বলেই জানাচ্ছেন খোদ রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী জয়ন্ত মিত্র ৷ সূত্রের খবর, রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়সীমাকে যেভাবে অগ্রেহ্য করেছে কমিশন তা অবমাননার সামিল বলেই খোদ কমিশনের নিয়োজিত আইনজীবী মহল মনে করছে ৷ কিন্তু এত কিছুর পরও রাজীবা সিনহার ঘুম কি ভাঙবে, প্রশ্ন থাকছেই ৷