কলকাতা, 8 জুলাই: দেশজুড়ে তখন বদলের হাওয়া ৷ 1977 সালের লোকসভা নির্বাচনে হেরে ক্ষমতার বাইরে গিয়েছে কংগ্রেস ৷ দেশের একাধিক রাজ্যে পড়ছে কংগ্রেসের সরকার ৷ পশ্চিমবঙ্গও বাদ যায়নি ৷ উত্তাল সাতের দশকের ধাক্কা সামলাতে পারলেন না সিদ্ধার্থ শংকর রায় ৷ প্রিয় বন্ধু ইন্দিরা গান্ধির মতো তিনিও তখন পরাজিত সেনাপতি ৷ সরকার 'হাত' ছাড়া হল ৷ ক্ষমতায় এল বামেরা ৷ মুখ্যমন্ত্রী হলেন জ্যোতি বসু ৷ ক্ষমতায় এসেই তিনি জানালেন, তাঁর সরকার মহাকরণ থেকে চলবে না ৷ রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে গরিব মানুষের নিজস্ব সরকার তৈরি হবে ৷ 1977 সালের 21 জুনের সেই ভাষণ এখনও প্রাসঙ্গিক ৷
রাজনৈতিক মহল মনে করেন এই ভাবনা থেকেই গ্রামবাংলায় তিনটি পৃথক স্তরের পঞ্চায়েতের জন্ম ৷ যে মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে বাংলার এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের শুরু তাঁর জন্মদিনেই দশম পঞ্চায়েত নির্বাচন দেখল রাজ্য ৷ এক অদ্ভুত সমাপতনেরও জন্ম হল ৷ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতি রাজ সারা দেশের কাছে একটি মডেল হয়ে ওঠে আটের দশকে ৷ খোদ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন এই মডেলকে ৷ তাঁর মনে হয়েছিল, সমাজের প্রান্তিক মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নে এই মডেল কার্যকরী ভূমিকা নেবে ৷ তাঁর উৎসাহে দেশের আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই ধরনের পঞ্চায়েত শুরু হয় ৷
তবে একটা কথা মনে রাখা দরকার ৷ বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচন বাম আমলে শুরু হলেও এই সংক্রান্ত আইন পাস হয়েছিল কংগ্রেস আমলেই ৷ এই আইন প্রণয়নের নেপথ্যে তৎকালীন রাজ্য মন্ত্রিসভার তরুণ সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকার কথা রাজনৈতিক মহল এখনও মনে করে ৷ 'লাঙল যার, জমি তার' স্লোগানকে সামনে রেখে ক্ষমতায় আসার পর সেই আইনে কয়েকটি পরিবর্তন করে বামেরা ৷ তারপরই শুরু হয় পঞ্চায়েতের জয়যাত্রা ৷ একদিক থেকে বাংলার পঞ্চায়েতী রাজ, অপারেশন বর্গাদারের মতোই বাম আমলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ৷
আরও পড়ুন: রাজ্যজুড়ে ভোটের হিংসার বলি 11; জেলায় জেলায় দেদার ছাপ্পা, বোমাবাজি, গুলি
একে একে দশটি নির্বাচন পেরিয়ে এল রাজ্য ৷ প্রথম থেকেই পঞ্চায়েত বামেদের শক্তঘাঁটি ৷ সেই ধারার পরিবর্তন হয় 2013 সালে ৷ ক্ষমতায় আসার বছর দু'য়েক পর রাজ্যে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার উপর একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেছে তৃণমূল ৷ তবে 2011 সালে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার প্রথম ইঙ্গিতও দিয়েছিল 2008 সালের পঞ্চায়েত ভোট ৷ নন্দীগ্রাম এবং সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনের সৌজন্য বামেদের বেকায়দায় ফেলতে শুরু করেছে তৃণমূল ৷ তারই প্রথম পদক্ষেপ ছিল পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ 24 পরগনার জেলা পরিষদ দখল ৷ এরপর 2009 সালের লোকসভা নির্বাচনে চমকে দেয় তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট ৷ এর আরও 2 বছর বাদে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল ৷
পঞ্চায়েত গঠনের নেপথ্যে জ্যোতি বসুর ভূমিকা স্মরণ করতে গিয়ে প্রবীণ সিপিএম নেতা রবীন দেব বলেন, "আজ থেকে 46 বছর আগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছিলেন জ্যোতিবাবু। সে অনুযায়ী রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয় । সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে গ্রাম সভা মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্মে মানুষের অংশগ্রহণ থাকত।" তবে তাঁর আক্ষেপ, গত এক দশকে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা শেষ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নয়, এখন রাজ্য পরিচালন করছেন জনা কয়েক নেতাই।
আরও পড়ুন:জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশ্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চের সূচনা
প্রবীণ বাম নেতা আরও বলেন, "অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মানুষকে তাঁর কাছে অভিযোগ জানাতে বলছেন। তিনি একজন সাংসদ মাত্র। তাঁর এভাবে রাজ্যের মানুষের মাসিহা হয়ে ওঠার কোনও অধিকার নেই । পঞ্চায়েতের গঠন সাধারণ মানুষের গণতন্ত্র এবং অধিকার রক্ষার জন্য ৷ আজ গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে তাঁরাই খুন হচ্ছেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন খুন হয়ে গিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন বহু মানুষ। ফলে রাজ্যের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াই মানুষ একেবারেই নিরুপায়। তাদের অধিকার রক্ষা হচ্ছে না। গণতন্ত্রকে খুন করা হচ্ছে। কিন্তু তারপরও বহু জায়গায় সাধারণ মানুষ জোট বদ্ধ হয়ে এই হিংসার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জ্যোতিবাবু স্বপ্নকে এইভাবে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে রাজ্য। "