কলকাতা, 10 জুলাই : তেল মাখা বাঁশে বাঁদরের ওঠানামা কিংবা চৌবাচ্চার জল মাপা । আজও কথাগুলো শুনলে কখনও চোখ পাকিয়ে কিংবা মাথা চুলকে উপরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে পড়ুয়ারা । কেউ কেউ আবার মনে মনে অঙ্ক ছাড়ার প্রতিজ্ঞাও করে । যাঁরা স্কুল-কলেজের পাঠ চুকিয়েছেন তাঁরাও এই নামটা শুনলে আজও খানিকটা ভয় পান । ইনি গণিতের ম্যাজিশিয়ান কেশবচন্দ্র নাগ । মজার ছলে, বাস্তব উদাহরণে একঘেয়ে কঠিন অঙ্কগুলিকে যেন এক আলাদা মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি । তবে শুধু গণিত নয় সাহিত্য থেকে খেলাধূলা, আধ্যাত্মিক চর্চা কিংবা নিজের গ্রামের উন্নয়ন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন লোকটি । বিশেষ করে খেলা তাঁর জীবনের অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল । মোহনবাগানের আজীবন সদস্য থাকা কে সি নাগ খেলা দেখতে গিয়েই 1985 সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ।
গুড়াপের শৈশব
1893 সালের 10 জুলাই । রথযাত্রার দিন । হুগলির গুড়াপের নাগপাড়ায় জন্মেছিলেন । শৈশবেই পিতা রঘুনাথ নাগের মৃত্যু হয় । মা ক্ষীরোদাসুন্দরী মানুষ করেন কেশব ও তার ভাইদের । স্থানীয় স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর সপ্তম শ্রেণিতে ভরতি হন ভাস্তাড়া যজ্ঞেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে । তারপর রিপন কলেজ । 1914 সালে প্রথম বিভাগে I.Sc পাশ করেন ।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্যে
1905 সাল । তখন কেশব সবে 18 । একদিন গঙ্গার ঘাটেই দেখা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে । ইলিশের দরদাম চলছে । ইলিশের মনের হিসেব নিয়ে এক মজার ঘটনা । সেখান থেকেই কেশবচন্দ্র নামটির সঙ্গে পরিচিতি । দক্ষিণ কলকাতার ছেলেমেয়েরা যাতে ভালোভাবে পড়ার সুযোগ পায় সেজন্য ভবানীপুরে মিত্র ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় । পরের বছরই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন । সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মিত্র ইনস্টিটিউশনের জন্যও শিক্ষক খুঁজছিলেন তিনি । এদিকে টুকটাক টিউশনি পড়ানো শুরু করেছেন কেশব নাগ । পরে বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন । তাঁর অঙ্কের ক্লাসগুলোতে তখন থেকেই ছাত্ররা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত । সহজ-সরল ভাষায়, মজার ছলে, নানা বাস্তব উদাহরণ দিয়ে কঠিন অঙ্ককেও জলবৎতরলং করে দিতেন । ধীরে অঙ্কের মাস্টার কেশবচন্দ্রের নাম ছড়াতে থাকে । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কানেও পৌঁছায় কেশবচন্দ্রের নাম । এরপর মিত্র ইনস্টিটিউশনে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কেশবচন্দ্র । পরে সেখানেই প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন তিনি । আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাবার বইটিকে পুনর্সংস্করণ করার সিদ্ধান্ত নেন । সেই বই প্রকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র ।
সাহিত্য অনুরাগী কেশবচন্দ্র
কেশবচন্দ্রের কাছে সাহিত্য খুব প্রিয় ছিল । মিত্র ইনস্টিটিউশনে তাঁর কবিশেখর কালিদাস রায় তাঁর বন্ধু হন । সেই সময় কালিদাস রায়ের বাড়িতে রসচক্র সাহিত্য সংসদ নামে নিয়মিত আড্ডা চলত । শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেকের যাতায়াত ছিল । সেই আড্ডায় নিয়মিত আসতেন কেশবচন্দ্রও । সেখান থেকেই বই লেখার ইচ্ছেটার পথচলা শুরু ।
নিজের গ্রামের উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র
নিজের গ্রামের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র । নিজের গ্রামে স্কুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পাঠাগার তৈরি সহ নানা কাজে তাঁর যোগদান ছিল । বাড়ির পাশে একটি আশ্রমও তৈরি করেছিলেন । সেখানে পড়াশোনা চলত । দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল । নানা বিপর্যয়ে এই আশ্রম থেকে দেশের নানা প্রান্তে ত্রাণ বিলি করা হত ।