কলকাতা, 10 সেপ্টেম্বর : গোটা দেশে চলছে আনলক পর্ব । কোরোনা আবহে বন্ধ রুটি-রুজির যোগানের সংকট কাটাতে এ ছাড়া উপায় ছিল না বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা । তাঁদের অনেকেই বলছেন, 54 দিনের লকডাউন এ যখন ফল আসেনি, তখন লকডাউন সমাধান নয় । প্রয়োজন সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির যথাযথ প্রয়োগ । ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে নিউ নর্মালে । আর তখন এ রাজ্যে মাঝেমধ্যেই চলছে লকডাউন । প্রশাসনের দাবি, বিশেষজ্ঞ দলের মতামতেই চলছে লকডাউন । এতে নাকি কমবে সংক্রমণ ।
রাজ্য সরকারের শেষ বুলেটিনে রিপোর্ট বলছে, এখনও পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা 1 লাখ 93 হাজার 175 জন। গত 24 ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন 3112 জন। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে সুস্থতার সংখ্যা 1 লাখ 66 হাজার 27 জন । গত 24 ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন 3035 জন । অর্থাৎ মাঝে কিছুদিন কম থাকলেও, সুস্থতার থেকে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও বেশি । রাজ্যে এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে 3771 জনের । পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয় । হয়ত বা সেই কারণেই রাজ্য প্রশাসনের তরফে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও সপ্তাহে একদিন, কোনও সপ্তাহে আবার দু'দিন লকডাউনের ঘোষণা করছে রাজ্য সরকার । কিন্তু সপ্তাহে কোনও দিন লকডাউন নেই এমন ঘোষণাও হয়েছে । বিষয়টিকে অপরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজ্যের বেশ কিছু চিকিৎসক সংগঠনের সদস্যরা ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা । তবে প্রশাসনের দাবি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশেই হচ্ছে এই লকডাউনের প্রক্রিয়া । যদিও বিশেষজ্ঞ কমিটির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন রাজ্যের অন্যতম বিরোধী নেতা সুজন চক্রবর্তী । তাঁর প্রশ্ন, আদৌ কি কোনও বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে ? আবার এই বিশেষজ্ঞ কমিটির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক তথা বাম নেতা ডাক্তার ফুয়াদ হালিম । যে বিশেষজ্ঞ কমিটির কথা রাজ্য সরকার জানাচ্ছে, সেখানে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা চিকিৎসক নেই বলে দাবি তাঁর । বিষয়টি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা পর্যন্ত দায়ের করেছেন তিনি । ফুয়াদ হালিমের মতো একই দাবি বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সজল বিশ্বাসেরও । তাঁর সংগঠন সার্ভিস ডক্টর ফোরামের তরফেও বিশেষজ্ঞ কমিটির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ।
এখনও পর্যন্ত রাজ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোন কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি হয়েছে ?
লকডাউনের শুরুতেই রাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দু'টি টাস্কফোর্স গঠন করে । সেইসঙ্গে নবান্নে কন্ট্রোল রুম এবং হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয় । তখন মার্চ মাস । 27 মার্চ 12 সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর । বলা হয়, এই কমিটি রাজ্যের কোরোনা পরিস্থিতির উপর নজরদারি করবে । সেই কমিটিতে ছিলেন দু'জন স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তা, পাঁচজন সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, পাঁচজন বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ । বলা হয় এই কমিটি হবে সর্বশক্তিমান । তাঁরা কোরোনা মোকাবিলায় কী করা উচিত, পরিকাঠামো, স্বাস্থ্য পরিষেবার সবকিছু দেখে রাজ্যকে পরামর্শ দেবে । এক নজরে দেখে নেওয়া যাক ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সেই কমিটিতে কারা কারা আছেন...
1. ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায়, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
2. ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরি, হেপাটলজি
3. ডাঃ আশুতোষ ঘোষ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার
4. ডাঃ মামেন কেনেডি, ডিরেক্টর, টাটা মেডিক্যাল সেন্টার
5. ডাঃ সুবীর দত্ত, প্যাথলজি
6. ডাঃ বিভূতি সাহা, মেডিসিন
7. ডাঃ ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়, চেস্ট মেডিসিন
8. ডাঃ বিভু কল্যাণী দাস, আনাস্থেসিয়া
9. ডাঃ সৌমিত্র ঘোষ, মেডিসিন
10. ডাঃ প্লাবন মুখোপাধ্যায়, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি
11. ডাঃ দেবাশীষ ভট্টাচার্য, ডিরেক্টর অফ মেডিক্যাল এডুকেশন, কনভেনার
12. ডাঃ অজয় চক্রবর্তী, ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস
আরও পড়ুন :রেকর্ড সংক্রমণ ! 45 লাখ ছাড়াল আক্রান্তের সংখ্যা
এই কমিটি নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ ফুয়াদ হালিমের । প্রসঙ্গত তিনি প্যানডেমিকের সময়েও জনসেবা করে চলেছেন । এর মধ্যে তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন কোরোনায় । একটা সময় তাঁর জীবন সংশয় পর্যন্ত হয়েছিল। কিন্তু এই বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ আমি একটা পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (জনস্বার্থ মামলা) ফাইল করেছি কলকাতা হাইকোর্টে । সেখানে আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি যে সর্বপ্রথম, একজন ভাইরোলজিস্ট এই বিশেষজ্ঞ কমিটিতে নেই । একজন এপিডেমিওলজিস্ট এই কমিটিতে নেই । একজন পাবলিক হেলথ সাইন্সের লোক এই বিশেষজ্ঞ কমিটিতে নেই । ফলে প্যানডেমিক নিয়ে সারা জীবন বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকা লোক কেউই এক্সপার্ট কমিটিতে নেই। ফলে যাঁরা আছেন তাঁরা না ভাইরাস নিয়ে কাজ করেছেন, না প্যানডেমিক নিয়ে কাজ করেছেন । ফলে তাঁদের পরামর্শ কতখানি কার্যকর হবে এই বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে । আর সেই কারণেই মামলা দায়ের করেছি ।"
এ প্রসঙ্গে সার্ভিস ডক্টর ফোরাম-এর সম্পাদক তথা বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ সজল বিশ্বাস বলেন, “ আমরা প্রথমেই সুনির্দিষ্টভাবে দাবি জানিয়েছিলাম, এই কমিটিতে প্যানডেমিক বিশেষজ্ঞদের রাখতে হবে । কমিটিতে রাখতে হবে ভাইরোলজিস্ট, প্য়ানডেমিক বিশেষজ্ঞ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ । পাশাপাশি আমাদের মত যে সংগঠনগুলি বিভিন্ন প্যানডেমিক নিয়ে কাজ করেছে সামাজিক দিক থেকে তাদের পরামর্শ নেওয়া হোক । কিন্তু সেই পরামর্শে রাজ্য সরকার কর্ণপাত করেনি । তারা তাদের মত মনগড়া কমিটি তৈরি করেছে । ফলে সেই কমিটি কী সুপারিশ করেছে সেটা দিয়ে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তৈরি হয় না । আমাদের মেডিকেল সাইন্সের জন্য বিশেষ বিশেষ বিভাগ রয়েছে। কোনও একটি বিভাগের সর্বোচ্চ বিশেষজ্ঞ অন্য বিভাগে গিয়ে সেই পারদর্শিতা দেখাতে পারবেন না । সুতরাং যাঁরা শুধুমাত্র আমার কথায় ওঠাবসা করবেন তাঁদের নিয়ে আমি একটা কমিটি বানিয়ে রেখে দিলাম তার কোনও মূল্য নেই ।"