তৎকালীন কলিকাতা পৌরসংঘের অল্ডারম্যান ৷ পরে মেয়র ৷ শহরকে তার কাঙ্খিত রূপ দেওয়াই ছিল বিধানচন্দ্র রায়ের লক্ষ্য ৷ শহরের শিক্ষা, চিকিৎসা, রাস্তাঘাট, আলো থেকে গরিবদের সমস্যা ৷ তার আমলে এক নতুন গতিতে কাজ শুরু করে কলাকাতা কর্পোরেশন ৷ এমনকি পৌরনিগমের কাজে স্বচ্ছতা আনতে তিনি প্রতিযোগতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থাও করেন ৷ বিধানচন্দ্রের হাত ধরে এক নতুন আলো দেখতে শুরু করেছিল শহর কলকাতা ৷ কেমন ছিল সেই সময়কালের কর্পোরেশনের উদ্যোগ ৷ কেমনভাবে সমস্ত কাজ পরিচালনা করতেন মেয়র বিধানচন্দ্র ৷ তা জানতে ফিরতে হবে তিরিশের দশকের কলকাতায় ৷
মেয়র বিধানচন্দ্র
1931-32 ও1932-33 ৷পরপর দু 'বছর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন বিধানচন্দ্র রায় ৷ প্রথমবার কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সময় তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু । দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জে এন মৈত্র ৷ বিধানচন্দ্র পেয়েছিলেন 42টি ভোট ৷ আর জে এন মৈত্র পান 26টি ভোট ৷ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পথে হাঁটতে চেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র ৷ মেয়র নির্বাচিত হয়ে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেন,"The outline of the canvas are there, we have to fill in the details...The broad features of the scheme are there...the power prestige the main and the money are there latest utilize them with the state for us and let us working unison to bring about the uplift of the poor... "
এর কয়েকদিন পরই গ্রেপ্তার হন তিনি ৷ কিন্ত কারাগারে থেকেও শহরের কর দাতাদের খবর নিতেনমেয়র বিধানচন্দ্র ৷
কলকাতাকে এক আধুনিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায় ৷ তাঁর উদ্যোগেই সেই সময় বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান শুরু হয়। এছাড়াও শহরের রাস্তাগুলির মান উন্নত করা হয় । কলকাতায় রাস্তায় রাস্তায় আলোর ব্যবস্থাহয় ৷ পানীয় জল যাতে আরও বেশি সংখ্যক মানুষ পান, সেই ব্যবস্থাও করেছিলেন তিনি ।সেইসঙ্গে শহরের বেহাল হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে অনুদান, তাদের পরিকাঠামো উন্নয়নে নানাপদক্ষেপ করেন ৷ তিনি মেয়র থাকাকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক শিক্ষিকাদেরবেতন বৃদ্ধি করা হয় ৷ এর আগে দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি বিবেচনাধীন ছিল ৷ কলকাতা কর্পোরেশন তথা তৎকালীন কলিকাতা পৌরসংঘে তাঁর কাজ ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল ৷ তিনিই প্রথম মেয়র ছিলেন, যিনি দুপুর থেকে কর্পোরেশনে এসে বিকেল তিনটে পর্যন্ত একটানা কাজ করতেন ৷ কাজের প্রতি কাউন্সিলরদের খামতিরও কড়া নিন্দা করতেন ৷ বলতেন, "behaving not like city-fathers but like children."
সেইসময় কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্ট্যান্ডিং কমিটি ছিল ৷ সেগুলির চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি ৷ যেমন বাজেট স্পেশাল কমিটি, ফিনান্স স্ট্যান্ডিং কমিটি, সার্ভিস স্ট্যান্ডিং কমিটি, পাবলিক হেলথ স্ট্যান্ডিং কমিটিইত্যাদি ৷ জল নিকাশি, আবর্জনা, শহরের খেলার মাঠ, ভিখারি সমস্যা একাধিক কমিটি পরিচালনাকরেছেন ৷
পরপর দু 'বছর মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন বিধানচন্দ্র রায় তাঁর স্বদেশপ্রেমও সর্বজনবিদিত ছিল ৷ 7 জুলাই ভোরবেলায় আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে দীনেশ গুপ্তরফাঁসি হয় ৷ সেদিন বিকেলের এক অধিবেশন হয় ৷ কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলররা অংশ নিয়েছিলেন সেই অধিবেশেন ৷ সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন মেয়র বিধানচন্দ্র রায়। দীনেশ গুপ্ত, তাঁরস্বদেশ প্রেমের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন তিনি ৷ বলেন, "এই যুবক তাঁর জীবনাদর্শকে সার্থক করিবার জন্য যে সাহস ও নিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন, আসুন আমরা সকলে মিলিয়া তৎপ্রতিশ্রদ্ধা নিবেদন করি ৷"
পৌরসভায় চাকরির জন্য প্রতিযোগতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা করেন বিধানচন্দ্র রায় ৷ যাতে কোনওসুপারিশ ও স্বজনপোষণ ছাড়া, যোগ্যতারভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ সম্ভব হয় ৷
তৎকালীন সময় পুলিশ বিভাগের স্পেশাল ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসার চার্লস টেগার্টের কুখ্যাতি ছিল ৷ দেশাত্মবোধ দমনেকড়া ভূমিকা নিয়েছিলেন ৷ অবসরের পর ইংল্যান্ডে গিয়ে কলকাতা কর্পোরেশনের সম্পর্কেনানা কটূক্তিও করেন তিনি ৷ বলেছিলেন, কলকাতা কর্পোরেশন সন্ত্রাসবাদীদের আড্ডাখানা ৷ এই বক্তব্যের কড়া নিন্দা করেছিলেন বিধানচন্দ্র ৷ বলেছিলেন, চার্লস টেগার্টের সমস্ত কথা বড় অসত্যও উদ্দেশ্যমূলক কুৎসা ।
মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গরিবদের সেবায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি ৷ কলকাতার গরিব মানুষদের সেবাও তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব রচনা করেছিলেন দেশবন্ধু ৷ সেইপ্রস্তাব উত্থাপন, তার বাস্তবায়নে নানা ভূমিকা নেন বিধানচন্দ্র ৷
মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র
1925 সালে রাজনীতিতে পদার্পণ ৷ ব্যারাকপুর থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়েন এবং সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন ৷ 1928 সালে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিতে নির্বাচিত হন তিনি ৷
1948 সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। কংগ্রেসের তরফে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বিধানচন্দ্র রায়ের নাম প্রস্তাব করা হয় ৷ পরে গান্ধিজির পরামর্শে 23 জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন বিধানচন্দ্র ৷ বাংলা তখন অশান্ত ৷ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খাদ্যাভাব, বেকারত্ব, উদবাস্তু সহ একাধিক সমস্যায় জর্জরিত ৷ দায়িত্ব পেয়েই আগে দলের নানা মহলে নিয়মানুবর্তিতা ও একতা আনার চেষ্টা করেন তিনি ৷ তারপর ধীরে ধীরে বাংলার এক একটি সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ করতে শুরু করেন ৷ বছর তিনেকের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে ৷ আইন-শৃঙ্খলা আবারদৃঢ় হতে শুরু করে ৷
কর্পোরেশনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিযোগতামূলক পরীক্ষা শুরু করেছিলেন একবার সাক্ষাৎ হওয়ার সুযোগ হয়েছিল বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে ৷ 139 তম জন্মবর্ষে তাঁর স্মৃতিচারণ করছিলেন অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী দেবাশিস সিংহ ৷ বাবা মহেন্দ্রনাথ সিংহ দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে । সেইসূত্রে ছাত্রাবস্থায় পরিচয় হয়েছিল ডাক্তারবাবু তথা বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ৷ পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছিলেন তিনি । বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন । কিছুক্ষণ কথাও বলছিলেন ৷ তবে বাবার কাছে থেকে অনেক ঘটনার কথা শুনেছিলেন দেবাশিসবাবু ৷ বয়স 70 পেরিয়েছে ৷ তবে বিধান-স্মৃতি এখনও সমানভাবে উজ্জ্বল ৷ তিনি বলেন, "বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন ৷ সেই সূত্রেই নানা ঘটনার কথা শুনেছি ৷ তখন পথের পাঁচালি তৈরি হচ্ছিল ৷ কিন্তু ছবিটি শেষ হওয়ার মুখে আর্থিক সমস্যায় পড়েন সত্যজিৎ রায় ৷ তখন সাহায্যের জন্য বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আসেন তিনি । সত্যজিৎ রায় এক লাখ টাকা বন্দোবস্ত করার আবেদন জানিয়েছিলেন ৷ বিধানচন্দ্র রায় তখন অর্থদপ্তরের কাছে সেই আবেদন পাঠিয়ে দেন ৷ কিন্তু অর্থ দপ্তর সেই আবেদন খারিজ করে দেয় ৷ কারণ এতদিন পর্যন্ত সিনেমার জন্য কোনও টাকা বরাদ্দ করেনি সরকার ৷ বিধানচন্দ্র আবার সেই আবেদন অর্থ দপ্তরকে পাঠায় ৷ শেষমেশ তিনি ক্যাবিনেট থেকে এক লাখ টাকা পাস করিয়ে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের হাতে তুলেদেন ৷ তারপর পথের পাঁচালি তৈরি হয় ৷ আর বাকিটা ইতিহাস ৷"
পশ্চিমবঙ্গ সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি ওয়েস্ট বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি করেছিলেন ৷ হিরণময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি হয়েছিল ৷ দেবাশিস সিংহের বাবা মহেন্দ্রনাথ সিংহ সেই কর্পোরেশনের প্রথম আর্থিক উপদেষ্টা ছিলেন ৷ তার অফিস হয়েছিল রাজভবনে ৷ বিধানচন্দ্র তখন যাদবপুরের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ৷ 1961 সালে 4 ফেব্রুয়ারি বিধানচন্দ্র রায়কে ভারতরত্ন দেওয়া হয় ৷ সেদিন কয়েকজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের সঙ্গে দেখা করে৷ তাঁদের দাবি ছিল, প্রেসিডেন্ট ভারতরত্ন পেয়েছেন, তাই তাঁর সম্মানে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি দেওয়া হোক ৷ তখন ছাত্রদের সামনেই বিধানচন্দ্ররায়কে ফোন করেন রেক্টর ৷ ফোনের ওপার থেকে বিধানচন্দ্র বলেন,"যে সকলছাত্র এসেছে, তাঁদের নাম নোট করে নাও ৷ বলে, পরবর্তী জীবনে তারা যেন সবাই ভারতরত্ন হয় ৷ ছুটি তো নয়, যেমন ক্লাস চলছে, চলেব ৷ " বলে চলেন দেবাশিসবাবু ৷ দেবাশিসবাবু আরও জানান, RG করএক সময় উঠতে বসেছিল ৷ বিধানচন্দ্র রায়ের পদক্ষেপেই হাসপাতালের পরিষেবা শুরু হয় ৷ এখন তো RG করবহাল তবিয়তে চলছে ৷ এর পিছনে কিন্তু বিধানচন্দ্রই রয়েছেন ৷
1962 সালের 24 জুন শেষবারের মতো রাইটার্স বিল্ডিং এসেছিলেন বিধানচন্দ্র ৷ সেদিন নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী বুদানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ৷ বুধানন্দের নানা প্রকল্পের কথা শোনেন ৷ সেই প্রকল্পগুলি বাস্তবায়ানের অনুমোদনও দেন ৷ 1 জুলাই ৷ তাঁর 80 তম জন্মদিন ৷ সকালে রোগী দেখার পর ব্রহ্মগীতের একটি অংশ গাইছিলেন ৷ প্রায় 11 ঘণ্টা পর বিকেলের দিকে শেষ নিঃশ্বাসত্যাগ করেন তিনি ৷ বাসভবনটিকে আগে থেকেই নার্সিংহোম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৷ মা অঘোরকামিনি দেবীর নামে নার্সিংহোম নামকরণের ইচ্ছেটাও জানিয়ে গেছিলেন ৷
ঋণ- ডাক্তার বিধান রায়ের জীবন চরিত ৷ অধ্যায় (কলিকাতা পৌরসংঘ) ৷