পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

মেদিনীপুরের ময়দানেই গেরুয়া শুভেন্দুর নব-উত্থান - অমিত শাহের সঙ্গে শুভেন্দু

তাঁর হাতেই দলের নতুন প্রজন্ম তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন মমতা । কিন্তু, আজ সেই শুভেন্দু অধিকারীই জোড়াফুলের বন্ধন ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে । যে মেদিনীপুরের মাটি মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল, সেখান থেকেই পরিবর্তনের ডাক দিলেন শুভেন্দু-অমিত শাহ । আলোচনায় শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী ।

অমিত শাহের সঙ্গে শুভেন্দু
অমিত শাহের সঙ্গে শুভেন্দু

By

Published : Dec 19, 2020, 5:23 PM IST

Updated : Dec 20, 2020, 9:07 AM IST

এমনটা বোধ হয় ভাবেননি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । নন্দীগ্রাম তাঁকে এভাবে ধাক্কা দেবে !

বড় বিশ্বাস ছিল তাঁর নন্দীগ্রাম নিয়ে । এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের আশীর্বাদ নিয়েই তো 2011 সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি । সেই নন্দীগ্রামের আশীর্বাদ এখন ফিকে । এই মেদিনীপুরের মাটিও যেন আজ বড্ড গুমোট । ডিসেম্বরের 19, বেলা 2.53 সময়টা বোধহয় মমতার কাছে খুব সুখের রইল না । নন্দীগ্রাম আন্দোলনের 'নেতা' শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের হাত থেকে বিজেপির পতাকা তুলে নিলেন ।

অথচ এই সেই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর, যা মমতাকে ক্ষমতায় আসার পথ দেখিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিল । সে-দিনের সেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে ভর করে বাংলার মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল 34 বছর ধরে একটানা শাসনক্ষমতায় থাকা বামেদের । আর রাজ্যসিংহাসনে বসেছিলেন মমতা ।

সেদিন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রধান কান্ডারি ছিলেন যিনি, সেই শুভেন্দু অধিকারী আজ বিজেপিতে । নন্দীগ্রামই তো অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলেটাকে শুভেন্দু বানিয়েছিল । নন্দীগ্রাম-জমি আন্দোলন না থাকলে আপাত শান্ত-ধর্মপ্রাণ ছেলেটার রাজনীতিতে সেভাবে হয়ত আসাই হত না ।

দলবদল শুভেন্দুর

অতি প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান । পারিবারিক সচ্ছলতা বরাবরই পেয়েছেন । বাবা শিশির অধিকারী প্রথম থেকে বড় নেতা ছিলেন না । কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত পঞ্চায়েতকেন্দ্রিক । তবে, ব্যবসায়িক সূত্রে মাসে একাধিকবার কলকাতায় যাওয়া-আসা লেগেই থাকত শিশিরের । সেই থেকেই কলকাতার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পরিচয় । ভোট প্রচারে অর্থ সাহায্য করার দায়িত্ব বরাবারই পালন করে এসেছেন শিশির । তখন থেকে কংগ্রেসে শিশির অধিকারীর সঙ্গে মমতার পরিচয় । মমতার হাত ধরে তৃণমূলে আসা । সাংসদ হওয়া । মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের আরও বাড়বাড়ন্ত । কিন্তু, এ সবের মধ্যে কোনও দিনই নিজেকে সেভাবে জড়িয়ে ফেলেননি পরিবারের মেজো ছেলে ।

অমিত শাহের সঙ্গে শুভেন্দু

বরং, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সন্ন্যাসীদের আখড়াই ছিল ছোটো ছোটো চুল কাটা ছেলেটার আসল ঠিকানা । অধিকারী পরিবারে কান পাতলে শোনা যায়, বরাবরই ধর্মের প্রতি একটু বেশি আবেগ ছিল ছেলেটার । সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসত । মন খুলে কথা বলত তাঁদের সঙ্গে । তাঁদের দেখেই ছোটো করে চুল কাটার অভ্যাস । এই অভ্যাসটা অবশ্য এখনও আছে শুভেন্দুর । এখনও সময়-সুযোগ পেলেই চলে যান মিশনে । কথা বলেন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে । শুভেন্দুর পরিচিতরা বলেন, সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আকর্ষণের জন্যই নাকি বিয়ে করেননি তিনি । সব হিসেব নিকেশ যেন পালটে যেতে লাগল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে । সংখ্যালঘু এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন অচিরেই হাইজ্যাক করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আর পূর্ব মেদিনীপুরের যুবক শুভেন্দু অধিকারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আন্দোলন পরিচালনার কাজ । সেই থেকেই অধিকারী পরিবারে লোকগাথার আসল নায়ক শুভেন্দু অধিকারী । শিশির অধিকারীর ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে যিনি নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়, পরিমণ্ডল এবং পরিবৃত্ত গড়ে তুলেছেন । আস্তে আস্ত শিশির অধিকারীর পরিচয় হয়ে ওঠে শুভেন্দু অধিকারীর বাবা হিসেবে ।

আরও পড়ুন :-নরেন্দ্র মোদির হাতে বাংলাকে তুলে দিতেই হবে, আহ্বান শুভেন্দুর

যত নন্দীগ্রাম আন্দোলনের রাশ আস্তে আস্তে মমতার হাতে আসতে থাকে, ততই নেত্রীর কাছের মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেন শুভেন্দু । নিছক এক বিধায়কের দুনিয়া ছেড়ে শুভেন্দু ডানা মেলেছেন বৃহত্তর দিগন্তে । দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক থেকে ডাকাবুকো লক্ষ্মণ শেঠকে ধুলিসাৎ করে তমলুকের সাংসদ হয়েছেন । সেখান থেকে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-র হাওয়ায় পাল উড়িয়ে নন্দীগ্রামের বিধায়ক । তৃণমূলে উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধি । সাংসদ ৷ একাধিক সংসদীয় কমিটির সদস্য ৷ রাজ্যের মন্ত্রী । সঙ্গে একাধিক কমিটির সদস্য । সরকারের পাশাপাশি দলেও গুরুত্ব বেড়েছিল শুভেন্দুর । মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মালদা থেকে অধীর-গড় মুর্শিদাবাদ । যখন যেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেখান থেকেই নেত্রীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন । সব থেকে বড় সাফল্য সম্ভবত মুর্শিদাবাদ ।

আরও পড়ুন :- তৃণমূল কর্মীদের খোলা চিঠি শুভেন্দুর

তৃণমূল অন্য দল ভাঙানোর কাজে দুই জনকে ব্যবহার করেছে বার বার । মুকুল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারী । মুকুল বছর তিনেক আগেই তৃণমূলের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন । কিন্তু, নিজের কাজটা ঠিক মতোই করে চলেছিলেন শুভেন্দু । একাধিকবার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, বিজেপিতে যোগ দেবেন তিনি । কিন্তু, প্রতি বারই সেই গুঞ্জন উড়িয়ে নিজের কাজ করে গিয়েছেন অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলে । পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগেনি । ধাপে ধাপে একাধিক পদক্ষেপ যেন বুঝিয়ে দিতে শুরু করে পরিস্থিতি বদলের ছবি । কখনও তা ইতিবাচক । কখনও আবার নেতিবাচক ।

মেদিনীপুরের সভায় শুভেন্দু

যেমন, এতদিন চর্চা হত নেত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ত্রয়ীকে নিয়ে । শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম ( ববি) ও অরূপ বিশ্বাস । এবার উঠে আসে শুভেন্দু অধিকারীর নাম । আর সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় । তৃণমূলের ছাত্র-যুব সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং সামনে নিয়ে এলেন শুভেন্দু অধিকারীর নাম । জানান দলের আগামী প্রজন্ম তৈরি করে দেওয়ার কাজ করবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভেন্দু । তৃণমূলের নেতৃত্বে অভিষেকের অভিষেক হয়েছিল আগেই । এবার শুভেন্দু ।

কিন্তু, এই উত্থানের মধ্যেই কোথায় যেন লুকিয়ে ছিল অসন্তোষের আগুন । শুভেন্দু-অভিষেকের জোড়া উত্থানের পাশাপাশি তাঁদের মধ্যে বিচ্ছেদের ব্যবধানটাও যেন বাড়তে শুরু করেছিল ।

আরও পড়ুন :- তোলাবাজ ভাইপো হটাও : শুভেন্দু

সালটা 2011 । তারিখ 21 শে জুলাই । যুব তৃণমূলের ব্যানারে পালন হচ্ছে দিনটা । স্বাভাবিক ভাবেই নেতা শুভেন্দুর মঞ্চে থাকার উচিত ছিল সেদিন । সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তাঁরই সভা পরিচালনা করার কথা, কারণ তিনিই তখন যুব তৃণমূল সভাপতি । কিন্তু, বৃষ্টিভেজা সেই দিনটায় হয়ত অন্য কিছুই লেখা ছিল । সে দিন সভা পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন দলের অপর এক নেতা । দলে তাঁর রকেট উত্থান অনেকের ঈর্ষার কারণ হয়ে গিয়েছিল । আর সে দিন একটিবারের জন্যও মঞ্চে দেখা যায়নি শুভেন্দুকে । নিন্দুকরা বলেন, সেই থেকেই দলের সঙ্গে বিচ্ছেদ-পর্ব শুরু হয় নন্দীগ্রাম আন্দোলনের যুব নেতা ।

দলের ভিতরে অবশ্য আলোচনা কোনও দিনই থেমে ছিল না । দলের অনেকেই মনে করতেন, অভিষেক অনিবার্যই ছিলেন । তবে শুভেন্দুর সাংগঠনিক দক্ষতার স্বীকৃতি দিয়ে এবং তাঁকে অভিষেকের সঙ্গে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের মুখ হিসাবে একই বন্ধনীতে এনে মমতা অভিষেককেই ‘চাপমুক্ত’ রাখার কৌশল নিয়েছিলেন । আর এখানেই সংকট ঘনীভূত । যা হয়তো নেত্রী কোনও দিনই ভাবতে পারেননি ।

আরও পড়ুন :- দক্ষ সংগঠক হলেও শুভেন্দু কি কোনওদিন মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ছিলেন ?

দল ক্ষমতায় এসেছে । শুভেন্দুর পাশাপাশি ক্ষমতা বেড়েছে অভিষেকের । প্রভাব বেড়েছে দলে । আর কোথায় যেন শুভেন্দু-অভিষেকের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেড়েছে । মমতার হাত থেকে দলের রাশ আলগা হয়েছে । অভিষেক গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন । আর শুভেন্দু-অভিষেকের ব্যবধান বেড়েছে । শুভেন্দুকে পরিবহন দপ্তর না দেওয়া নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয় । শুভেন্দু ঘনিষ্ঠরা বলেন, উপ–মুখ্যমন্ত্রী করে পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভার শুভেন্দুর হাতে ছেড়ে দিলে 2019-এর লোকসভা ভোট অন্যরকমও হতে পারত । এমনও শোনা যায় যায় পঞ্চায়েত দপ্তর চাইলেও, পরিবহনে ঠেলে দেওয়া হয় শুভেন্দুকে । এ সবই প্রমাণ করতে থাকে দলে শুভেন্দুর প্রকৃত অবস্থান কোথায় । বিচ্ছেদ তারপর শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল ।

মেদিনীপুর-নন্দীগ্রাম মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল । সেই মাতঙ্গিনীর মাটিতে দাঁড়িয়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে মঞ্চে নিয়ে অমিত শাহ বাংলায় পরিবর্তনের ডাক দিলেন ।

আরও পড়ুন :- যত হিংসা করবেন বিজেপি তত বেশি আপনার মোকাবিলা করবে, মমতাকে হুঁশিয়ারি অমিতের

সত্যিই কি বাংলায় পরিবর্তন আসছ? উত্তর পেতে এখনও বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে ।

কিন্তু, আজ যে ঝড় তুলে শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দিলেন, তা কি শেষ পর্যন্ত থাকবে ? 2021 -এর বাংলায় কি উঠবে গেরুয়া হাওয়া ? দিনের শেষে এই প্রশ্নগুলিও মেদিনীপুর কলেজ ময়দান থেকে তামাম রাজ্যের ধুলোয় উড়ে বেড়াচ্ছে ।

Last Updated : Dec 20, 2020, 9:07 AM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details