এমনটা বোধ হয় ভাবেননি নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । নন্দীগ্রাম তাঁকে এভাবে ধাক্কা দেবে !
বড় বিশ্বাস ছিল তাঁর নন্দীগ্রাম নিয়ে । এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের আশীর্বাদ নিয়েই তো 2011 সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি । সেই নন্দীগ্রামের আশীর্বাদ এখন ফিকে । এই মেদিনীপুরের মাটিও যেন আজ বড্ড গুমোট । ডিসেম্বরের 19, বেলা 2.53 সময়টা বোধহয় মমতার কাছে খুব সুখের রইল না । নন্দীগ্রাম আন্দোলনের 'নেতা' শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের হাত থেকে বিজেপির পতাকা তুলে নিলেন ।
অথচ এই সেই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর, যা মমতাকে ক্ষমতায় আসার পথ দেখিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিল । সে-দিনের সেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনে ভর করে বাংলার মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল 34 বছর ধরে একটানা শাসনক্ষমতায় থাকা বামেদের । আর রাজ্যসিংহাসনে বসেছিলেন মমতা ।
সেদিন নন্দীগ্রাম আন্দোলনের প্রধান কান্ডারি ছিলেন যিনি, সেই শুভেন্দু অধিকারী আজ বিজেপিতে । নন্দীগ্রামই তো অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলেটাকে শুভেন্দু বানিয়েছিল । নন্দীগ্রাম-জমি আন্দোলন না থাকলে আপাত শান্ত-ধর্মপ্রাণ ছেলেটার রাজনীতিতে সেভাবে হয়ত আসাই হত না ।
অতি প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান । পারিবারিক সচ্ছলতা বরাবরই পেয়েছেন । বাবা শিশির অধিকারী প্রথম থেকে বড় নেতা ছিলেন না । কাজের পরিধি সীমাবদ্ধ ছিল মূলত পঞ্চায়েতকেন্দ্রিক । তবে, ব্যবসায়িক সূত্রে মাসে একাধিকবার কলকাতায় যাওয়া-আসা লেগেই থাকত শিশিরের । সেই থেকেই কলকাতার কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পরিচয় । ভোট প্রচারে অর্থ সাহায্য করার দায়িত্ব বরাবারই পালন করে এসেছেন শিশির । তখন থেকে কংগ্রেসে শিশির অধিকারীর সঙ্গে মমতার পরিচয় । মমতার হাত ধরে তৃণমূলে আসা । সাংসদ হওয়া । মেদিনীপুরে অধিকারী পরিবারের আরও বাড়বাড়ন্ত । কিন্তু, এ সবের মধ্যে কোনও দিনই নিজেকে সেভাবে জড়িয়ে ফেলেননি পরিবারের মেজো ছেলে ।
বরং, রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সন্ন্যাসীদের আখড়াই ছিল ছোটো ছোটো চুল কাটা ছেলেটার আসল ঠিকানা । অধিকারী পরিবারে কান পাতলে শোনা যায়, বরাবরই ধর্মের প্রতি একটু বেশি আবেগ ছিল ছেলেটার । সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মিশতে ভালবাসত । মন খুলে কথা বলত তাঁদের সঙ্গে । তাঁদের দেখেই ছোটো করে চুল কাটার অভ্যাস । এই অভ্যাসটা অবশ্য এখনও আছে শুভেন্দুর । এখনও সময়-সুযোগ পেলেই চলে যান মিশনে । কথা বলেন সন্ন্যাসীদের সঙ্গে । শুভেন্দুর পরিচিতরা বলেন, সন্ন্যাস জীবনের প্রতি আকর্ষণের জন্যই নাকি বিয়ে করেননি তিনি । সব হিসেব নিকেশ যেন পালটে যেতে লাগল নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে । সংখ্যালঘু এবং সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন অচিরেই হাইজ্যাক করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আর পূর্ব মেদিনীপুরের যুবক শুভেন্দু অধিকারীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন আন্দোলন পরিচালনার কাজ । সেই থেকেই অধিকারী পরিবারে লোকগাথার আসল নায়ক শুভেন্দু অধিকারী । শিশির অধিকারীর ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে যিনি নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়, পরিমণ্ডল এবং পরিবৃত্ত গড়ে তুলেছেন । আস্তে আস্ত শিশির অধিকারীর পরিচয় হয়ে ওঠে শুভেন্দু অধিকারীর বাবা হিসেবে ।
আরও পড়ুন :-নরেন্দ্র মোদির হাতে বাংলাকে তুলে দিতেই হবে, আহ্বান শুভেন্দুর
যত নন্দীগ্রাম আন্দোলনের রাশ আস্তে আস্তে মমতার হাতে আসতে থাকে, ততই নেত্রীর কাছের মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করেন শুভেন্দু । নিছক এক বিধায়কের দুনিয়া ছেড়ে শুভেন্দু ডানা মেলেছেন বৃহত্তর দিগন্তে । দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক থেকে ডাকাবুকো লক্ষ্মণ শেঠকে ধুলিসাৎ করে তমলুকের সাংসদ হয়েছেন । সেখান থেকে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’-র হাওয়ায় পাল উড়িয়ে নন্দীগ্রামের বিধায়ক । তৃণমূলে উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধি । সাংসদ ৷ একাধিক সংসদীয় কমিটির সদস্য ৷ রাজ্যের মন্ত্রী । সঙ্গে একাধিক কমিটির সদস্য । সরকারের পাশাপাশি দলেও গুরুত্ব বেড়েছিল শুভেন্দুর । মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মালদা থেকে অধীর-গড় মুর্শিদাবাদ । যখন যেখানে দায়িত্ব পেয়েছেন, সেখান থেকেই নেত্রীর মুখে হাসি ফুটিয়েছেন । সব থেকে বড় সাফল্য সম্ভবত মুর্শিদাবাদ ।
আরও পড়ুন :- তৃণমূল কর্মীদের খোলা চিঠি শুভেন্দুর
তৃণমূল অন্য দল ভাঙানোর কাজে দুই জনকে ব্যবহার করেছে বার বার । মুকুল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারী । মুকুল বছর তিনেক আগেই তৃণমূলের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন । কিন্তু, নিজের কাজটা ঠিক মতোই করে চলেছিলেন শুভেন্দু । একাধিকবার গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, বিজেপিতে যোগ দেবেন তিনি । কিন্তু, প্রতি বারই সেই গুঞ্জন উড়িয়ে নিজের কাজ করে গিয়েছেন অধিকারী পরিবারের মেজো ছেলে । পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগেনি । ধাপে ধাপে একাধিক পদক্ষেপ যেন বুঝিয়ে দিতে শুরু করে পরিস্থিতি বদলের ছবি । কখনও তা ইতিবাচক । কখনও আবার নেতিবাচক ।