কলকাতা, 7 ডিসেম্বর : হায়দরাবাদের নির্যাতিতার জন্য বিচার চেয়ে ইতিমধ্যেই মোমবাতি জ্বালিয়ে কলকাতার পথে নেমেছে ডাক্তার, নার্স সহ ডাক্তারি ও নার্সিংয়ের পড়ুয়াদের একাংশ । আর, এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন যাতে আর না হয়, তার জন্য মার্শাল আর্টের হাত ধরে এবার পথের খোঁজ দিচ্ছে NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তায়কোন্দোর ক্লাস । কারণ, বলা হচ্ছে, সদ্যজাত শিশু থেকে শুরু করে ১০০ বছরের বৃদ্ধা, কোথাও কেউ সুরক্ষিত নন।
2017-র 1 মার্চ থেকে NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শুরু হয়েছে কোরিয়ার মার্শাল আর্ট তায়কোন্দোর ক্লাস । এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট, ডাক্তার দ্বৈপায়ন বিশ্বাস বলেন, "হায়দরাবাদের ঘটনা অতি জঘন্য । তবে, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । এই ধরনের জঘন্য ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে । এর একটা কারণ সামাজিক অবক্ষয় ।" তিনি বলেন, "সামাজিক অবক্ষয় ঠেকানোর জন্য আমরা তায়কোন্দোর ক্লাস শুরু করেছিলাম । আমরা চেয়েছিলাম, যাঁরা এটা শিখবেন, মানসিক-শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার পাশাপাশি আধ্যাত্মিকভাবেও তাঁরা সক্ষম, সবল হবেন । তায়েকোন্দোর লক্ষ্য হচ্ছে একে অন্যকে সম্মান করা ।"
হায়দরাবাদের মতো ঘটনা কেন ঘটবে ? এই প্রশ্ন তুলে ডাক্তার দ্বৈপায়ন বিশ্বাস বলেন, "আমাদের মেয়েরা অবশ্যই মার্শাল আর্ট শিখবে এডুকেশন হিসেবে । এডুকেশন হিসাবে একটি পার্ট রয়েছে সেল্ফ ডিফেন্স, সেটি অবশ্যই শিখবে । কিন্তু, আমাদের ছেলেরা এমন কাণ্ড কেন ঘটাবে যাতে মেয়েদের মার্শাল আর্ট শিখতে হবে আর তা প্রয়োগ করতে হবে?" তিনি বলেন, "আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মেয়েরা যেমন আত্মরক্ষার পাঠ শিখবে, এর পাশাপাশি ছেলেদেরও এমন শিক্ষা দেওয়া হবে যে, মেয়েদের যেন মার্শাল আর্ট শেখার প্রয়োগ করতে না হয় ।" ডাক্তার দ্বৈপায়ন বিশ্বাস শুধুমাত্র এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টই নন, এর পাশাপাশি তিনি তায়কোন্দোর স্টেট নোডাল অফিসার । তাঁর কথায়, "মার্শাল আর্ট শিখে একে অন্যকে সাহায্য করবে, সম্মান করবে, সুস্থ, স্বাভাবিক একটা সমাজ গড়ে উঠবে, এটাই আমাদের উদ্দেশ্য । আমার মতে, ভারতের সমস্ত নাগরিকের মার্শাল আর্ট শেখা উচিত । কারণ, যে কোনও ধরনের মার্শাল আর্ট সেলফ ডিসিপ্লিন, সেলফ কন্ট্রোল শেখায় ।"
NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিকেল পড়ুয়া, জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তার, নার্স, নার্সিংয়ের পড়ুয়া সহ এখানকার অন্য যে কেউ তায়কোন্দোর এই ক্লাসে পাঠ নিতে পারেন । এখানে মার্শাল আর্ট শিখছেন এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনোকোলজি বিভাগের ডাক্তার অনুরাধা ফাদিকার । হায়দরাবাদের এই ঘটনার বিষয়ে 57 বছর বয়সি এই ডাক্তার বলেন,"আমরা অন্য কারও উপর নির্ভর করতে পারি না । তাই আমাদের সুরক্ষা নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে ।"
সিনিয়র এই ডাক্তার বলেন, "আমরা মা দুর্গাকে পুজো করি । কারণ, তিনি শক্তির প্রতীক । আমি মনে করি, প্রতিটি মেয়ের মধ্যে মা দুর্গা আছেন । এটা ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে । জাগিয়ে তুলতে হবে । জাগানোর কাজ করে মার্শাল আর্ট ।" তিনি বলেন, "এরফলে, একজন মানুষ, শুধুমাত্র মহিলা নন, যে কোনও মানুষ যদি চর্চা করেন, তাহলে শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে তিনি পুরোপুরি সক্ষম হবেন । কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লে, তৎক্ষণাৎ যে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কীভাবে নিজেকে প্রতিরক্ষা করে আক্রমণ করব, কীভাবে ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসব, এই বিষয়ে এই আর্টের মাধ্যমে আমরা নিজেদের তৈরি করতে পারি ।"
NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক মেডিকেল পড়ুয়া মধুছন্দা প্রামানিক বলেন, "শুধুমাত্র মেয়েদের নয়, সকলেরই তায়কোন্দো শেখা উচিত । তায়কোন্দো সবার জন্য । এটা শুধুমাত্র আমাদের আত্মবিশ্বাস দেয় না, আত্মরক্ষাও শেখায় । পরিস্থিতির সঙ্গে কীভাবে, কী করতে হয়, সেটা খুব ভালোভাবে শেখায় । মানসিক পরিণতির জন্য মার্শাল আর্ট এতটাই সাহায্য করে যে, ছেলে-মেয়ে সকলের এটা করা উচিত ।" হায়দরাবাদের ঘটনার বিষয়ে এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তায়েকোন্দোর এই ছাত্রী বলেন, "শুধুমাত্র আত্মরক্ষা নয় । কঠোর আইন হওয়া উচিত, যাতে এই ধরনের ঘটনা আর না হয় ।" এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অন্য এক মেডিকেল পড়ুয়া দেবস্মিতা সোরেন । তিনিও এখানকার তায়কোন্দো ক্লাসের ছাত্রী । তাঁর কথায়, "হায়দরাবাদের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক । এরকম কেউ চায় না । জানি না, কেন এই ধরনের ঘটনা হচ্ছে । আমাদের ভাবতে হবে, একজন মেয়ে হিসাবে কীভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা সম্ভব ।" তিনি বলেন, "মার্শাল আর্ট লড়াইয়ের জন্য নয়, এটা মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করে । ওই মুহূর্তে কী করা উচিত, তায়েকোন্দো অবশ্যই সেটা শেখায় । আমি মনে করি, মার্শাল আর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ ।
NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তায়কোন্দোর চিফ ইন্সট্রাক্টর, তায়কোন্দো হল অফ ফেম গ্র্যান্ড মাস্টার প্রদীপ্ত কুমার রায় বলেন, "শান্তির জন্য কাজ করে চলেছে তায়কোন্দো । কীভাবে আমরা শান্তি পেতে পারি? এই যে এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে, এটা হচ্ছে পাশবিক মানসিকতা । এই ধরনের মানসিকতাকে যদি আমাদের অতিক্রম করতে হয়, তা হলে এই ট্রেনিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, যাকে বলা হয় মার্শাল আর্ট ।" মেয়েদের নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা খুব দরকার । যে কোনও ছেলে বা মেয়ের মানসিক দৃঢ়তা এবং শারীরিক সক্ষমতা যখনই বাড়বে, তখনই একজন মানুষ সুস্থ সবল নাগরিক হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন । এই ধরনের পাশবিক আচরণ ঘটবেই না । এ কথা জানিয়ে হায়দরাবাদের ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, "যদি মার্শাল আর্ট জানা থাকত, তা হলে সেই ক্ষেত্রে, আমি তায়কোন্দোর ক্ষেত্রে অন্তত বলতে পারি যে, মানসিক দৃঢ়তা এবং শারীরিক সক্ষমতা থাকলে এই ধরনের সিচুয়েশন হয়তো হতো না । এবং, সেই সিচুয়েশন থেকে নিজেকে বের করে আনতে সক্ষম হতো । আমি চাই এই সতর্কতা সকলের মধ্যে আসুক ।" তাঁর কথায়, "তায়কোন্দোর ট্রেনিংটা যদি স্কুল লেভেল থেকে দেওয়া হয়, এই অ্যালার্টনেস তৈরি হবে । তাতে এই ধরনের পাশবিক মন-ও তৈরি হবে না । একটি মেয়ে, সারাদিন ধরে যাকে বিভিন্ন পরিস্থিতিকে ওভারকাম করতে হয়, সেগুলিকে কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে । এটা জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ । যে কারণে, এটাকে বলা হয় ওয়ে অফ লাইফ ।"
তায়কোন্দো শিখছেন শিবাঙ্গী বিশ্বাস । তিনি বলেন, "এটা প্রথম নয়, এর আগেও অনেকবার । এটাকে একটা ডিজ়িস বলে যেতে পারে ।" তাঁর কথায়, "তায়কোন্দো করলে আমাদের মানসিকতা খুব শুদ্ধ থাকে, চিন্তা থাকে না । মেয়েরা আত্মরক্ষার জন্য এটা করতে পারে, কিন্তু ছেলেদেরও শেখা উচিত । কারণ, এটা শিখলে ছেলেদের মন-ও পরিষ্কার হয়ে যাবে । মন পরিষ্কার থাকলে এসব ঘটার কোনও প্রশ্নই ওঠে না ।" তায়কোন্দো হল অফ ফেম মাস্টার রুমা রায় চৌধুরি । তিনিও NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তায়কোন্দো শেখান । তিনি বলেন, "মার্শাল আর্ট সম্পর্কে একটি বড় ব্যাপার হল, মার্শাল আর্ট যে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য উপকারী তা কিন্তু নয় । মার্শাল আর্ট হচ্ছে একটি ফিলোসফি । এটা একটা এথিকস । যেটা প্রতিটি মানুষের নিজেকে জানার অধিকার রয়েছে । আমাদের মন হচ্ছে মাংকি মাইন্ড । আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না ।" মহিলাদের আজকে এরকম একটি জায়গায় পৌঁছতে হবে কেন? এই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, "মার্শাল আর্টে হচ্ছে একমাত্র এর সমাধান । এটা করলে প্রত্যেকের শারীরিক এবং মানসিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাড়ে । মার্শাল আর্ট এই কারণে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নয় । এটা সমাজের প্রত্যেকের জন্য । "আমি কে", সেটা জানার জন্য সকলের এটা শেখা উচিত ।"