কলকাতা, 31 অগাস্ট: আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতক আগে নীরদ সি চৌধুরি লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। আর আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল । কিন্তু দলের বাঙালি নেতারাই তখন তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন । জ্যোতিবাবুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি ।
অনেক উথালপাথালের পর UPA-র রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । নাম ঘোষণার সময়ে সোনিয়া গান্ধি এবং মনমোহন সিংহের মাঝখানে দাঁড়ালেন তিনি । করুণানিধির প্রতিনিধি টি আর বালু তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিলেন সোনালি রঙের গরদের চাদর । শরদ পাওয়ার থেকে অজিত সিং সকলে হাততালিতে মুখর । এক জন সেদিন সেখানে ছিলেন না, তিনি বঙ্গললনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । শুধু ছিলেন না বললে ভুল হবে, প্রণববাবুর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথে প্রধান বাধা হয়েছিলেন তিনিই ।
কেন এমন হল?
মমতা যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, তখনও এই দুই নেতার সম্পর্ক ছিল আপাত-মধুর । মমতা প্রায়ই 13 নম্বর তালকাটোরা রোডে প্রণববাবুর বাসভবনে যেতেন । রেল বাজেটের ব্যাপারে প্রণববাবুর পরামর্শ নিতেন । যখনই যেতেন, তখনই মমতা সঙ্গে নিয়ে যেতেন চকোলেট । ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও অম্লান বদনে মমতার দেওয়া চকোলেট খেতেন প্রণববাবু । এ নিয়ে একবার পরিচিত মহলে প্রণববাবু বলেছিলেন, “কী করা যাবে? ও যে মমতা । ও কিছু বললে না শুনে উপায় আছে?”
রেল মন্ত্রককে যাতে পরিষেবা কর দিতে না হয়, তার জন্য প্রণববাবু অতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করেছিলেন বাজেটে । বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে যতই বাদানুবাদ হোক, মমতা-প্রণব সম্পর্ক ছিল বেশ অনেকটাই সাধারণ । প্রণববাবু কালীঘাটে মমতার বাড়িতেও গিয়েছেন বেশ কয়েকবার । নিজের আত্মজীবনীতে মমতার প্রশংসাও করেছেন । তাহলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় এই দুই জনের সম্পর্ক বিপরীত মেরুতে অবস্থান করতে শুরু করেছিল কেন? এর কারণ হিসেবে অনেকে বলেন, এই বিরোধ যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব এবং আবেগের সংঘাত । যার সূচনা হয় প্রণববাবুর অর্থমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ।
পশ্চিমবঙ্গের জন্য তিন বছরের মোরাটোরিয়াম চেয়েছিলেন মমতা । মমতার অভিযোগ, সেই সুযোগ না দিয়ে অর্থমন্ত্রী রাজ্যকে বঞ্চিত করেন । তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় মমতার বক্তব্য ছিল, যিনি রাজ্যকে আর্থিক সাহায্য করলেন না, তাঁকেই তৃণমূল সমর্থন করবে? তা হলে রাজ্যের মানুষের কাছে কী জবাব দেওয়া হবে? যদিও প্রণববাবু বহু বার অমিত মিত্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, প্রকল্প-ভিত্তিক আর্থিক সাহায্য দেওয়া সম্ভব হতে পারে । কিন্তু কোনও একটি রাজ্যকে পৃথক ভাবে মোরাটোরিয়াম দেওয়া সম্ভব নয় । কেন নয়, তাও বুঝিয়েছিলেন তিনি ।
তবে শুধুই কি আর্থিক প্রস্তাবগুচ্ছ আর মোরাটোরিয়াম নিয়ে বিরোধ? অনেকের যুক্তি যদি সেটাই কারণ হত, তা হলে তো মমতার খুশি মনে প্রণববাবুকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বলে মেনে নেওয়ার কথা ছিল । কারণ, সে ক্ষেত্রে অন্য কেউ অর্থমন্ত্রী হতেন । এবং তাঁকে সামনে রেখে মমতা দাবি আদায়ের সুযোগ পেতেন ।
তাঁদের যুক্তি, আসল কারণ লুকিয়ে ছিল চা-আমন্ত্রণের মধ্যে । 34 বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রণববাবুকে মহাকরণ চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মমতা । চিদম্বরমের মতো নেতারা গেলেও প্রণববাবু যাননি । আর এতেই ক্ষুব্ধ হন মমতা । আসলে, এ জাতীয় বিষয় কোনও দিনই পছন্দ করতেন না প্রণব মুখোপাধ্যায় । আর এটাও ঠিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ-ভাবনা চিন্তা-রাজনীতি করার ধরনের দিক থেকে মমতা-প্রণব সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর ।
ছোটোখাটো চেহারার প্রণব মুখোপাধ্যায় সব সময়ই রাশভারী প্রকৃতির । প্রয়োজনের থেকে বেশি কথা বলা কখনই পছন্দ করতেন না । ধুরন্ধর কূটনীতিক থেকে দেশের অন্যতম সফল মন্ত্রী-সংসদের নাম প্রণব মুখোপাধ্যায় । জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কোনও দিনই নজর কাড়তে পারেননি । 1980 তে ইন্দিরা জমানায় যখন অতি সাধারণ কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন, সে সময়ও বোলপুর থেকে লড়াই করে হারতে হয়েছিল তাঁকে । রাজনৈতিক মস্তিষ্ক-কূটনৈতিক চিন্তাভাবনায় তিনি ছিলেন অনন্য । কিন্তু, 'জনগণের নেতা' এটা কোনও দিনই হতে পারেননি প্রণব মুখোপাধ্যায় ।
অন্য দিকে, রাস্তায় নেমে রাজনীতিই হল মমতার পরিচয় । বার বারই নিজেকে 'তোমাদের লোক' হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করেন তিনি । মমতার রাজনীতি করার ধরন সম্পূর্ণ প্রণবের বিপরীত । আবার মমতা যে উগ্রতায় বামেদের বিরোধিতা করে এসেছেন, তাও অনেক সময় পছন্দ ছিল না প্রণববাবুর । মানসিকতার মিল তেমন ভাবে না থাকলেও তাঁরা নিজেদের মধ্যে অনেকটা সমঝোতা করেই চলতেন ।
সন্দেহ নেই, মমতার থেকে অনেক বেশি দিন ধরে রাজনীতির ইনিংস খেলেছেন প্রণববাবু । একই রাজ্যের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত রাজনীতিতে কোনও নতুন ঘটনাও নয় । প্রণববাবুর সঙ্গে অশোক সেনের এক সময় মতপার্থক্য হয়েছিল । ইন্দিরা-জমানায় প্রণববাবুর সঙ্গে বরকত গনি খান চৌধুরির প্রবল সংঘাতের কাহিনিও সুবিদিত । প্রিয়রঞ্জনের সঙ্গে প্রণববাবুর সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর । এখনও সেই সংঘাতের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে । তবে যাই হোক, প্রণববাবু শেষ দিন পর্যন্ত বলে গিয়েছেন, ‘‘মমতা আমার বোনের মতো”৷ আর রাষ্ট্রপতি নন, প্রণব মুখোপাধ্যায় হলেন মমতার প্রণবদা ।