কলকাতা, 17 মে : আশঙ্কাটা সত্যি হল । গ্রেপ্তারের কালো মেঘ এ বার কলকাতার প্রাক্তন নগরপাল রাজীব কুমারের মাথার উপর । আজ গ্রেপ্তার না করার রক্ষাকবচ রাজীব কুমারের উপর থেকে সরিয়ে নিল সুপ্রিম কোর্ট । সন্দেহ নেই শীর্ষ আদালতের এই দিনের সিদ্ধান্তে শুধু রাজীব নয়, বিড়ম্বনা বাড়তে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারেও ।
যদিও আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনটা হওয়ারই ছিল । তাঁদের যুক্তি, রাজীবের উপর বলবৎ থাকা রক্ষাকবচ তুলে নেওয়া ছিল কেবলই সময়ের অপেক্ষা । আর যে দিনই পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজীবকে দিল্লিতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন, সে দিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ছবিটা ।
তথ্য-পরিসংখ্যান বলছে রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর । বিতর্কের সূত্রপাত বেশ কয়েক বছর আগেই । তাঁর বিরুদ্ধে CBI-এর আভিযোগ, সারদাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন-সহ অন্য়ান্য অভিযুক্তদের মোবাইলের বিকৃত কল ডিটেলস রেকর্ড (CDR) তাদের হাতে তুলে দেন রাজীব । CDR বিকৃত করার পাশাপাশি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার অভিযোগও রয়েছে রাজীবের বিরুদ্ধে । শীর্ষ আদালতে সারদা-রোজভ্যালি সমেত অন্যান্য চিটফান্ড মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা CBI-এর বিশেষ SP পার্থ মুখোপাধ্যায় একটি অতিরিক্ত হলফনামা পেশ করেছিলেন । সেই হলফনামায় তিনি আদালতকে জানান, রাজীব কুমার ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং দুর্নীতি দমন আইনে অভিযুক্ত হওয়ার মতো অপরাধ করেছেন । হলফনামার 11 এবং 12 নম্বর পরিচ্ছদে তিনি শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছিলেন, রাজ্য পুলিশের কাছে অনেক তদ্বির এবং অনুরোধের পর সুদীপ্ত সেন এবং অন্যান্য অভিযুক্তদের মোবাইলের কল রেকর্ডস CBI-এর হাতে তুলে দেন রাজীব কুমার । সেই CDR এবং মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার কাছ থেকে CBI যে CDR সংগ্রহ করেছিল তার মধ্যে বিস্তর ফারাক পাওয়া গেছে ।
এই সংক্রান্ত আরও পড়ুন : রক্ষাকবচ তুলল সুপ্রিম কোর্ট, সাতদিন সময় রাজীবকে
এরপর CBI দাবি করে, সারদা, রোজ়ভ্যালি এবং টাওয়ার গ্রুপের মতো চিটফান্ডের সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলের আর্থিক লেনদেনের তথ্য তাদের হাতে এসেছে । CBI-এর অভিযোগ, রাজীব কুমার রাজ্য সরকারের তৈরি করা স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (SIT)-এর অন্যতম প্রধান তদন্তকারী হিসেবে ওই সমস্ত চিটফান্ডের বিরুদ্ধে থাকা তথ্য গোপন করেছেন । আর তাই রাজীব কুমারকে অবিলম্বে জিজ্ঞাসাবাদ বা জেরা করা প্রয়োজন বলে দাবি তুলে সুপ্রিম কোর্টে যায় CBI । এর মাঝে রাজীবকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তার বাড়িতেও যায় CBI-র টিম । কিন্তু, রাজীবের সঙ্গে পক্ষপাতদুষ্ট ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযোগে কলকাতার ধর্মতলায় ধরনায় বসেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তারপরই বিষয়টিতে ফের হস্তক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট । সে সময় ফেব্রুয়ারি মাসে শীর্ষ আদালত শিলংয়ে রাজীব কুমারকে CBI-এর প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার নির্দেশ দেয় । কিন্তু, একই সঙ্গে রাজীবকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না CBI- এই মর্মে রক্ষাকবচও দেয় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ ।
আরও খবরের জন্য ক্লিক করুন : কমিশনের সময়সীমার 2 ঘণ্টা পর ডিউটি জয়েন রাজীব কুমারের
রাজীবকে টানা পাঁচদিনের জেরা পর্বের রিপোর্ট গোয়েন্দারা মুখ বন্ধ খামে শীর্ষ আদালতকে জমা দেয় । সেই রিপোর্ট দেখে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘অত্যন্ত গুরুতর।’’ তখনই CBI-এর তরফে হলফনামা পেশ করে জানানো হয়, CBI তদন্ত শুরু হওয়ার আগে রাজ্য সরকার গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT)–এর অন্যতম প্রধান কর্তা হিসাবে সারদা তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন রাজীব কুমার । CBI অভিযোগ করে, রাজীব কুমারের নির্দেশেই মামলার প্রধান দুই অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন এবং দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের ফোনের কল ডিটেলস-এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে । তা ছাড়া দেবযানীর ল্যাপটপ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলতে সাহায্য করেছে রাজীব কুমারের নেতৃত্বাধীন পুলিশ । হদিশ মেলেনি ডায়েরি-সহ বেশ কিছু নথির।
CBI শীর্ষ আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিল, ওই নথি উদ্ধার করার জন্য রাজীব কুমারের মতো প্রভাবশালী পুলিশকর্তাকে গ্রেপ্তার করে নিজেদের হেপাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়োজন । একই সঙ্গে রাজীব কুমারকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলে শীর্ষ আদালতের যে রক্ষাকবচ দেওয়া রয়েছে, আদালত যাতে তা প্রত্যাহার করে নেয়, সেই আবেদনও জানানো হয় । সেই আবেদনের ভিত্তিতে রাজীব কুমারকেও পালটা হলফনামা পেশ করতে বলেছিল আদালত । সেই হলফনামায় রাজীব দাবি করেছিলেন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অন্তর্বর্তী অধিকর্তা নাগেশ্বর রাওয়ের স্ত্রী এবং মেয়ে চিটফান্ডের সঙ্গে যুক্ত । সেই মামলার তদন্ত কলকাতা পুলিশ করছে । সেই কারণেই ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে CBI তাঁকে হেনস্থা করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছিলেন রাজীব ।
যদিও এ দিন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রাজীবের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করল । CBI-এর অনুরোধ মেনেই রাজীবের উপর থেকে রক্ষাকবচ সরিয়ে নিল আদালত । বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে বিপদ বাড়ল রাজীবের । যদিও প্রাথমিক ভাবে সাতদিন সুযোগ পেয়েছেন রাজীব । কিন্তু, সাতদিনের মধ্যে নিজের সুরক্ষা বলয় তৈরি করতে পারবেন রাজীব ? এটাই বোধ হয় এখন লাখ টাকার প্রশ্ন ।