কলকাতা, 15 অগস্ট: সময়টা গত শতাব্দীর চারের দশক । আজকের কলকাতার সঙ্গে তার আমূল পার্থক্য । চারদিক ফাঁকা, দক্ষিণ কলকাতা তো আরও জনবসতিহীন । সেখানেই একরাতে ব্রিটিশ পুলিশের গাড়ি এসে থামল একটি দোতলা বাড়ির সামনে । পাড়ায় সেসময় ব্রিটিশ পুলিশের গাড়ি মানেই ভীত-সন্ত্রস্ত গোটা এলাকা । পুলিশ অফিসার নেমেই দরজায় কড়া নাড়লেন । শঙ্কিত গৃহস্বামী দরজা খুলতেই পুলিশ অফিসার সার্চ ওয়ারেন্ট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন । প্রমাদ গুনলেন গৃহস্বামী ।
কাট টু প্রেজেন্ট:
শ্রাবণ মাসের মেঘলা আকাশ । রাস্তার মোড়ে মোড়ে পালন হচ্ছে 77তম স্বাধীনতা দিবস ৷ দেশপ্রিয় পার্কের উলটোদিকের রাস্তা ধরে 50 মিটার হাঁটলে ডানদিকে বিপিন পাল রোড। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে 6-এ বাড়িটি । অবস্থান ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের বাড়ির ঠিক পিছনে । গঠনশৈলীতে পুরনো ছাঁচ স্পষ্ট । বাড়িটি আজও বহন করে চলেছে রোমহর্ষক ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল ।
ফ্ল্যাশব্যাক:
গৃহস্বামীকে নিয়েই বাড়ির অন্দরে ঢুকলেন পুলিশ অফিসার । পুলিশের ভারী বুট নৈশব্দ ভাঙছে আর আতঙ্কে চমকে উঠছেন গৃহস্বামী । অবশেষে পুলিশ পৌঁছল দোতলার সেই ঘরে । যেখানে লুকিয়ে রয়েছেন জ্যোতিষচন্দ্র বসু, হরিদাস মিত্র, পবিত্রমোহন রায় এবং অমরসিং গিল । চারজনেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সিক্রেট সার্ভিসের সদস্য । হাতেনাতে ধরা পড়লেন চার বিপ্লবী । বাজেয়াপ্ত হল ওদের রেডিও সেটটি ।
অন্যদিকে নেতাজি তখন আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন । ভারতে ব্রিটিশদের গতিপ্রকৃতি এবং পরিকল্পনা জানতে খুলেছিলেন আইএনএ সিক্রেট সার্ভিস । বাংলায় যার এজেন্ট ছিলেন এই চার যুবক। প্রত্যেকেরই বয়স পঁচিশের নীচে। তাদের মধ্যে সদ্য ওকালতি পাশ করা হরিদাস মিত্র আবার বিবাহিত । বিয়ে করেছেন এলগিন রোডের বিখ্যাত বসু পরিবারের মেয়ে বেলারানি বসুকে। তিনি সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইঝি । ফলে ব্রিটিশ পুলিশের কেস সাজাতে কোনও অসুবিধা হল না । কলকাতায় বিচার হয়েছিল । বিচারক বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ধৃত চার যুবককেই মৃত্যুদণ্ড দিলেন ।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতা আন্দোলনে কতজন বাঙালি জেল খেটেছিলেন, কতজনের হয়েছিল ফাঁসি, জানেন কি ?
হরিদাস মিত্রের মাত্র একবছর বিয়ে হয়েছে । তারমধ্যেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজিকে সাহায্য করার কারণে ফাঁসির সাজা ঘোষণা হয়েছে । স্বামীকে মৃত্যুর হাত বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা শুরু করলেন বেলারানি । মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল । এলগিন রোডের বাড়িতে গান্ধিজি, জহরলাল নেহেরু আলোচনার জন্য আসলে অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্ব বর্তাত বেলারানির উপরে । কিন্তু গান্ধিজিকে চিনলে তো হবে না । কোথায় তাঁকে পাওয়া যাবে ? অবশেষে জানা গেল গান্ধিজি রয়েছেন পুণেতে । মরিয়া বেলারানি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ছুটলেন ।
অন্যদিকে, অধুনা বাংলাদেশের যশোর থেকে জ্যোতিষচন্দ্র বসুর বাবা কলকাতায় এসেছিলেন ছেলের প্রাণভিক্ষার আর্জি নিয়ে । বেলারানির সঙ্গী হলেন একপ্রকার জোর করেই । যদিও পুণে পৌঁছেও সহজে দেখা পাওয়া গেল না গান্ধিজির । তিনদিন অপেক্ষার পর অবশেষে মিলল সুযোগ । বেলারানিকে চিনতে পারলেন গান্ধিজিও । কিন্তু জ্যোতিষচন্দ্র বসুর বাবা অচেনা । তিনি কী বলতে চাইছেন তা বুঝতে পারছিলেন না স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ । কারণ, একে বাংলা তার ওপর পদ্মাপাড়ের টান । এই অবস্থায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন বেলারানি । স্বামী হরিদাস মিত্র এবং বাকি তিন সহযোগীর প্রাণ বাঁচাতে গান্ধিজিকে উদ্যোগী হতে অনুরোধ করলেন ।