হায়দরাবাদ, 31 ডিসেম্বর: 'যাওয়ার বেলা....' কেউ রেখে গেছেন সুখ-স্মৃতি, কেউ বা বিতর্ক । তারপরেও থেকে যায় স্মৃতিটুকুই। 2023 সালে বাংলা হারিয়েছে বেশ কয়েকজন বিশিষ্টদের । যাঁরা বাঙালির মননে থেকে যাবেন চিরকাল।
অনুপ ঘোষাল
গুপীর কন্ঠ চিরঘুমে। বছর শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন অনুপ ঘোষাল । 15 ডিসেম্বর 2023,সঙ্গীতের ক্যানভাসকে ফিকে করেই চলে গেলেন সত্যজিতের প্রিয় গায়ক। বয়স হয়েছিল 78 ৷ তাঁর কন্ঠে সত্যজিতের ছবি যেন জীবনকে উদযাপনের বার্তা দিত । আহা কী আনন্দ ,দেখ রে নয়ন মিলে.... পায়ে পরি বাঘ মামা, ওরে হাল্লা রাজার সেনা....একের পর এক সত্যজিতের সৃষ্টিতে উদার কন্ঠে গেয়ে গেছেন অনুপ। তাঁর অবাধ সঙ্গীত যাত্রা থেমে থাকেনি, নজরুল গীতি থেকে শ্যামা সঙ্গীতেও সমান দক্ষতা রেখে গেছেন তিনি। হিন্দি গানেও তাঁর অবদান না ভোলার । গুলজারের কথায়, আর ডি বর্মনের সুরে - 'তুজসে নারাজ নেহি জিন্দেগি' আজও চিরন্তন । রাজনীতির ময়দানেও তাঁকে দেখা যায় 2011 সালের বিধানসভা নির্বাচনে। প্রথমবার প্রার্থী হয়েই জয় আসে । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে টিকিট দেন। উত্তরপাড়া বিধানসভা আসনে জয়ী হন অনুপ। যদিও পরবর্তীতে রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে গায়কের । 2011 সালে নজরুল স্মৃতি পুরস্কার, 2013 সালে সঙ্গীত মহাসম্মানে সম্মানিত হন মহান এই গায়ক ৷
সুমিত্রা সেন
" আজ মা ভোরে চলে গেলো... ", ফেসবুক পোস্ট সুমিত্রা কন্যা শ্রাবণী সেনের । রবীন্দ্রসঙ্গীতে শেষ হল 'সুমিত্রা যুগ'। কালজয়ী অধ্যায়ের ইতি 2023 সালের 3 জানুয়ারি। দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর প্রয়াত প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেন। সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয়, বারো বছর আগে ঠিক একই দিনে প্রয়াত হন সুচিত্রা মিত্র। দুজনেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে 2012 সালে 'সঙ্গীত মহাসম্মান'-এ সম্মানিত করে ৷ তাঁর দুই মেয়ে ইন্দ্রাণী সেন ও শ্রাবণী সেন সঙ্গীত জগতে বিখ্যাত ৷ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে সুমিত্রা সেনের অবদান কখনই ভোলা যাবে না ৷ রবীন্দ্র-গানের 'সুচিত্রা ঘরানা' যেমন মনমুগ্ধকর, তেমনই অন্য আবেগে ভাসায় 'সুমিত্রা ঘরানা'। সেই ধারা বজায় রাখছেন কন্যা শ্রাবণী সেন এবং ইন্দ্রাণী সেন। নব্বই ছোঁয়ার আগেই ইহলোক ত্যাগ করলেন সুমিত্রা সেন ।
সুভাষ চক্রবর্তী
না ফেরার দেশে 'লাল পাহাড়ি দ্যাশে যা' স্রষ্টা সুভাষ চক্রবর্তী । 24 ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হন বিখ্যাত এই লোকসঙ্গীতশিল্পী । রাঢ় বাংলার টানে তাঁর লেখা ও সুর-লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা, আজও বাংলার ঘরে ঘরে চলে। খুব বেশি প্রচারের আলোয় তাঁকে দেখা যায়নি । হয়ত বা থেকে গেছেন ব্রাত্য । বাঁকুড়ার মাটিতেই শিল্পীর জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা, গান রচনা থেকে সুরের সৃষ্টি । দীর্ঘ অসুস্থতায় কাবু হন সুভাষ। ভর্তি ছিলেন কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৷ 71 বছর বয়সে চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন সুভাষ চক্রবর্তী । রেখে গেলেন লাল মাটির আদি অকৃত্রিম স্মৃতি। বাঁকুড়া ছাড়তে চাইতেন না তিনি । সকলের আড়ালেও নিজের মাটিকে ছিলেন আঁকড়ে। গ্রাম বাংলার টান তাঁর লেখায় যেন প্রস্ফুটিত ।
সমরেশ মজুমদার
উত্তপ্ত সময়ের দুই চরিত্র অনিমেষ-মাধবীলতা ৷ তাঁদের ভালোবাসা ও লড়াই চলেছে সমানভাবে ৷ দুই চরিত্রের স্রষ্টা সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার রেখে গেলেন সেই 'কালবেলা'৷ চলে গেলেন 79 বছরে ৷ 8 মে 2023, কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে চিরঘুমের দেশে চলে যান সমরেশ । রেখে গেলেন সাতকাহন, গর্ভধারিনী, উত্তরাধিকার,কালপুরুষ ও কালবেলার মতো একাধিক অমোঘ সৃষ্টি । অনেকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন সাহিত্যিক ৷ তবে তাঁর কলম কোনওদিনি থেমে থাকেনি । তিনি লিখে গিয়েছেন । জীবনের শেষ কটাদিনেও অসুস্থ অবস্থায় লিখতে চেয়েছিলেন সমরেশ । পারেননি, কারণ স্বাস্থ্য সঙ্গ দেয়নি। সমরেশ মজুমদারের লেখায় নতুন দিক পায় উত্তরবঙ্গের রাজনৈতিক পটভূমিকা। সাহিত্যিকের ছোট থেকে বড়বেলা কেটেছে উত্তরবঙ্গেই । তাই তাঁর লেখাতেও বার বার এসেছে চা-বাগান ও উত্তরবঙ্গ । পরবর্তীতে কলকাতায় এসে পড়শোনা, লেখালেখি । আগুনে লেখার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই অনাবিল এক স্বাধীনচেতা মনোভাবের নামই সমরেশ।