কলকাতা, 9 ফেব্রুয়ারি:অনেকের মতোই দু'চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বামী ও ছোট দুই সন্তানকে রেখে উপার্জনের আশায় পাঁচ মাস আগে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতার মোমিনপুরের এই তরুণী ৷ নিজের শহর আর দেশ ছেড়ে কাজের আশায় আরব দেশে পাড়ি দেওয়ার সেই দিনটা তাঁর কাছে ছিল স্বপ্নের মতো । তবে চলতি মাসের 5 জানুয়ারি যখন তিনি আবার দমদম বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলেন তখন পালটে গিয়েছে সবকিছু ৷ এই পাঁচমাসেই ভেঙেছে তাঁর স্বপ্ন, বিদেশে জুটেছে অপমান, অত্যাচার, নিগৃহ ৷ সেইসব ঘটনার ছাপ স্পষ্ট তরুণীর চোখেমুখে ৷
কলকাতায় ফিরে এসেও নিগৃহীতার শরীরে ক্লান্তির ছাপ ৷ চোখ দুটি মুখের তুলনায় অনেকটাই ছোট হয়ে যেন কোটরে প্রবেশ করেছে । যে চোখে একদিন সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন চকচক করেছিল সেই চোখে আজ শূন্যদৃষ্টি এবং তা অশ্রুস্নাত । কপর্দকশূন্য এক জীবন ৷ কেন হল এমনটা? বিদেশে এই 5 মাসে কী ঘটেছিল তাঁর সঙ্গে?
মোমিনপুরের ঘিঞ্জি এলাকা থেকে সোজা দুবাই । অর্থ উপার্জনের আসায় এতটা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন এই তরুণী ৷ লকডাউনের পরে স্বামীর বেকারত্ব ফলে সংসার চালানো এবং সন্তানদের মুখে দুবেলা দু'মুঠো খাবার তুলে দেওয়াই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য ৷ চেয়েছিলেন দুবাইয়ে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে বাড়িতে টাকা পাঠাতে ৷ আশা করেছিলেন দুবাইতে কাজ করে মাসে নিশ্চয়ই কয়েক হাজার টাকা তিনি বাড়িতে পাঠাতে পারবেন (Woman Trafficking) ৷
আরও পড়ুন: 2 সন্তানকে শ্বাসরোধ করে খুনে অভিযুক্ত মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা
কিন্তু সবসময় ভাবনা আর বাস্তব যে মেলেনা সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে মোমিনপুরের এই তরুণীর গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা । বিদেশে গেলে যে ভাগ্যের চাকা ঘোরে এবং আর্থিক সচ্ছলতা মেলে তা অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি হয় না । ভারত,বাংলাদেশ-সহ আরও বহু দেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর অল্প বয়সি ও মাঝ বয়সি মহিলাদের সৌদি আরব-সহ উপসাগরীয় বহু দেশে পাঠান হয় অর্থ রোজগারের প্রলোভন দেখিয়ে ৷ কিন্তু সেইসব দেশে গিয়ে অনেককেই সম্মুখীন হতে হয় কঠিন সব পরিস্থিতির ৷ আপাদমস্তক ঝাঁ চকচকে শহরের নীচেও থাকে প্রদীপের তলার অন্ধকার (Woman Trafficking in Oman) ৷
মোমিনপুরের এই নির্যাতিতা তরুণী যেন সাক্ষাৎ তারই উদারণ ৷ তাঁর কথায়,"আমাকে কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে দুবাই নিয়ে যাওয়া হয় । দুবাইতে একটি ফ্ল্যাটে আমরা প্রায় 25 জন মহিলা ছিলাম । আমাদের থেকে পাসপোর্ট এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল । দুবাইতে আমাকে একজন শেখের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে পাঠানো হয় । এরপর আমি বাড়ি আসব বলায় আমাকে দুবাই থেকে ওমানের এজেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । সেখানেও আমাকে আরেক শেখের বাড়িতে কাজে বহাল করা হয় । ওই বাড়িতে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনও চলতে থাকে । ঠিকমতো খেতেও দেওয়া হত না ৷"
তরুণীর দাবি, আর না-থাকতে পেরে যখন তিনি বাড়ি ফেরার কথা বলেন, তখন এক মহিলা এজেন্ট তাঁকে জানায়, এক লক্ষ টাকা জমা দিলে তবেই তাঁকে বাড়ি ফিরতে দেওয়া হবে ৷ নির্যাতিতার কথায়,"আমি একবার রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গিয়েছিলাম । অনেক খোঁজাখুঁজি করে ওখানকার থানায় যাই । কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না । আমার এজেন্ট এসে থানার লোকেদের সঙ্গে রফা করে আমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল । আর তারপর অত্যাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল ।" তিনি বলেন,"আমাকে দু'লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিল । আমার মতো অনেক মেয়ে ওখানে আটকে রয়েছেন । এই পাঁচ মাসের কাজের বিনিময় আমি এক পয়সাও বেতন পায়নি । উলটে আমার স্বামীকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে হয়েছিল এজেন্টকে ।"
আরও পড়ুন : লটারির লোভে 200 বার টাকা পাঠান অপরাধীকে ! 72 লক্ষ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হিমাচলের বাসিন্দা
তরুণীর দাবি, তিনি পালিয়ে এলেও তাঁর মতো বহু মহিলা ওমান, সৌদির মতো দেশে এরকম নারকীয় জীবন কাটাচ্ছেন ৷ তাঁদের থেকে পাসপোর্ট, ফোন নিয়ে নোযা হয়েছে ৷ কাজ করিয়ে দেওয়া হয় না অর্থ ৷ আর কাজ না করতে চাইলে জোটে মার ৷ শুধুই লাঞ্ছনা । এক অবর্ণনীয় শারীরিক ও মানসিক পীড়ন । তরুণীর দাবি লকডাউনে তাঁর স্বামী কাজ হারান ৷ তাই রোজগারের আসায়, স্বামী ও সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে তিনি বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ সেটাই কাল হয়েছে তাঁর ৷ মোটা বেতনের পরিচারিকার কাজের প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে মহিলাদের পাচার করা হয় ৷ এরসঙ্গে কলকাতার একটি চক্রও জড়িত আছে ৷ মার্গারেট বলে কলকাতার এক মহিলার নামও করেছেন তিনি (Kolkata Lady Harrased in Oman)৷
এই প্রসঙ্গে নির্যাতিতার স্বামী বলেন,"দুবাই বলে আমার স্ত্রীকে যে ওমানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা আমি জানতাম না । ওমানে পৌঁছে অনেক দিন পর আমার স্ত্রী যখন আমাকে ফোন করে সব জানায় তখনই আমি সবটা জানতে পারি । তারপরেই আমি আর সময় নষ্ট না করে স্থানীয় বিজেপি কর্মী ইমরান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করি । এরপর বিজেপি নেতা শিশির বাজরিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে পুরো বিষয়টি জানাই । এরপর তিনি দিল্লিতে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তিনি নিজে দুবাই গিয়ে ওখানকার দূতাবাসের মাধ্যমে আমার স্ত্রীকে উদ্ধার করেন ।"
ইটিভি ভারতের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে দিল্লি এবং দুবাইয়ের এজেন্টদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তারা ফোন তোলেননি । এরপর মার্গারেটে নামে এই মহিলার সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয় । মার্গারেট ইটিভি ভারতকে জানান, টাকার বিনিময় কখনওই মহিলাদের বিদেশে পাঠানো হয় না এবং বিদেশে তাঁর কোনও এজেন্টের সঙ্গে যোগ নেই । মোমিনপুরের এই মহিলাকে সেখানে পাঠাতে তাঁর কোনও হাত ছিল না বলেও দাবি মার্গারেটের ৷ তবে তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন নিগৃহীতা ৷ বাকি মহিলাদেরও ওইসব দেশ থেকে উদ্ধারের দাবি করেছেন তিনি ৷